পথের ফাঁকে...

ভাবছি বেশ তো বয়স হলো, এবার অবসর নিয়েই ফেলি৷ এই সেদিন ই যন্ত্রণায় কাতর সারারাত৷ সকালে দেখলাম সরকারি দপ্তর থেকে লোক এসে মেরামত করে দিয়ে গেল ভেঙ্গে যাওয়া জায়গাটা৷ তারপর এই একটু স্বস্তিতে আছি বেশ কদিন৷ জানো বুঝতে পারি যে দিন ফুরিয়ে এসেছে যখন সদ্য হওয়া বৃষ্টির জলে ভরে ওঠে এ দেহে তৈরি হওয়া নতুন ফাঁক-ফোঁকর৷
দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে দেখে চলেছি এ পৃথিবীতে জীবনের আনাগোনা৷ অদ্ভুত বিষাদ জন্মেছে আজ এ পৃথিবীর পরিবর্তিত রূপ দেখে৷ পাশে একটা বড় খাল ছিল৷ বেশ ঠান্ডা হাওয়া আসত সেখান থেকে৷ খুব গরমে যখন ফাটছে আমার পিচের স্তর তখন স্বস্তির নিশ্বাস হয়ে বয়ে আসত সেই নবপ্রয়াত খালের বাতাস৷ অবসর নিঝুম রাতে যখন জেগে বলতে শুধু আমি আর অনেক সময়ের তফাতে আমার ওপর দিয়ে যাওয়া লরির দল তখন সেই খালটি ই ছিল আমার বন্ধু৷ আজ সে ইতিহাস,তার অস্তিত্বে আজ দাগ কেটেছে তার ওপর উঠে যাওয়া লম্বা ফ্ল্যাটবাড়ি৷ কতো পথিকের তৃষ্ণা মিটিয়ে আজ সে রয়ে গিয়েছে হয়তো কোনও তৃষ্ণার্ত কবির কলমের দাগে৷
সেদিন দেখলাম "বলো হরি,হরি বল" বলতে বলতে চলেছে কিছু মানুষের দল৷ দেখি তাদের পিঠে চলেছে হারুর মায়ের মৃতদেহ৷ হ্যাঁ আমি চিনি তাঁকে৷ তাঁকে দেখতাম রোজ বসে স্বপ্নের নগর সাজাতে৷ দুই কূলে তার নিজের বলতে শুধু একটি ছেলে৷ বর টাও বা ঘর সংসার করল কই? বরের অকাল বিরহ ও ভবঘুরে স্বভাবের কারণেই সংসারটা টিকল না৷  তবে যখনই কোনও মৃতদেহকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে দেখত সে, তখন তাঁর চোখ থেকে দু ফোটা জল পড়তো আমার ওপর৷ সে মনে মনে স্বপ্ন গড়ত যে একদিন তার দেহটিকেও ঠিক এরকম ভাবে নিয়ে যাওয়া হবে৷ আসলে ছোট্টবেলা থেকে সে কখনো সুখের মুখ দেখেছিল না৷ তার সে স্বপ্ন সাজিয়েছিল সুখে মরবার৷ আজ তার স্বপ্নটিকে বাস্তব হতে দেখে মনটা শান্তির আভাষ পেল৷
তবে এটা মনে হতেই পারে যে এই নগণ্য একটা রাস্তা ,তার আবার এত চিন্তা-ভাবনা৷  রাজপথ হলেও নয় একটা কথা ছিল৷
আসলে রাজপথ নই বলে যে স্মৃতিরাশির অভাব ঘটা উচিত,এর কি কোনও মানে আছে? হয়তো আমার ওপর দিয়ে চলেনি কখনো একটিও রাজার রথ,পড়েনি কখনো কোনও রাজ- ঐশ্বর্যের ধুলো৷ তবে যখন যখন আমার ওপর দিয়ে বাসে চড়ে মানুষের দল তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য শহরের দিকে এগিয়েছে,তখন তাদের স্বপ্নের অংশীদার ছিলাম আমিও৷ যখন ক্লান্ত পথিক আমার ধারে বেড়ে ওঠা গাছের নীচে আশ্রয় নিয়েছে,তখন স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েছি আমি৷
জানো বেশ বছর খানিক আগে হঠাৎ লরির ধাক্কায় প্রাণ হারাল এক শিশু৷ সেদিন রক্তে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল আমার এ শরীর৷ কতো বর্ষায় মেতেছি ছেলের দলের সাথে জল ছিটানোর খেলায়৷
হে রাজপথ,
"না ই বা হলাম তোমার ন্যায় রাজনীতিতে পটু,
না ই বা করলাম রাজা-প্রজাদের মধ্যে ভেদাভেদী,
আমি ভাল আছি,রাজপথ...
করছে না মোর অঙ্গে কোথাও রাজনৈতিক ক্ষত দগদগ...."
বয়স হয়েছে অনেক৷ ভাবছিলাম অবসরের কথা৷ হলাম তো অনেক সংগ্রাম- আন্দোলনের সঙ্গী৷ এবার নয় মুক্ত করা হোক আমায়৷
আচ্ছা আমি কি কোথাও ভুল করে ফেলছি? অবসর বলে কিছু কি আছে এ জীবনে? আমার জীবন বলতে তো শুধু পাথর আর পিচের স্তর৷
জানো অনেক ভোরে ঝাড়ুদারগুলোর ঝাড়ুর সুড়সুড়িতে নতুন জীবনের গন্ধ ভাসে....

No comments:

Post a Comment