লুসিফার

“তোমাকে হারিয়েছি বেশীদিন হয়নি,তবু কিছু যুগ পেরিয়েছে বলতে পারো।আমি এখনও সেই মূর্খটি রয়ে গেছি, বদলেছে বলতে জীবনটা। রোদ ঝিলমিলে দুপুর গুলো এখন খবরের কাগজ পড়ে কাটাই আর চায়ের কাপে চুমুক দিতেই পিঠে রোদ এসে উষ্ণ চুম্বন করে তোমায় ফিরিয়ে দিয়ে যায়। তোমার কাছে চিঠি লিখতে বসেছি বহুবার, কিন্তু ওই ... রান্নার লোকের খুন্তি নাড়বার আওয়াজ বার বার আমায় সংবিগ্ন করেছে। সকালের পাখির ডাক আমায় কাঁদিয়ে তুলেছে কেবল সঙ্গিহারা হওয়ার শোকে।পাওনা বলতে কেবল সেই গোধূলি-বেলা, আকাশ তখন যেন আমাদের বিচ্ছেদ শোককে প্রকৃতির আকার দিয়ে তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়।

 বয়সটা একটু বেড়েছে জানো, আর বেড়েছে তিক্ততা।পিপাসা কমেছে অনেকটা তবু কোথাও একটা রক্তের পিপাসা রয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ রক্তের...প্রতি রাতে এখন স্বপ্ন আসে আমাদের সেই শেষ দেখা, আজ থেকে বোধ্যয় দু-যুগ আগে, তাই নয় কি? আজও স্বর্গের কথা শুনলে মনটা লাফিয়ে ওঠে, মনে হয়, এই বুঝি বাড়ি ফেরার পালা।কিন্তু পরোক্ষনেই মেনে নিতে হয় যে আমি বহিষ্কৃতদের দলেই আজও।জানো আমার দুঃখ নেই স্বর্গ হারানোর , দুঃখ নেই কোন বিচ্ছেদের...তবে দুঃখ বলতে কেবল তোমাকে হারানোর।তোমায় আমি যত বার কাছে পেয়েছি নারী রূপে, প্রতিবার দূরে সরিয়ে দিয়েছে আমাদের নিয়তি।এত নিষ্ঠুর প্রেম-গাথা লেখে বলেই আজ সে ঈশ্বর।তিন যুগ পেরিয়ে আজ অনেকটা বুর হয়ে গেছি, এটাই স্বাভাবিক।মৃত্যু ঘটেছে কত বার, কত রাত কেটেছে নির্জন দ্বীপে পথে প্রান্তরে। একটু ক্লান্ত পড়ে পরেছি ঠিকই কিন্তু জানো আজও রক্তের খিদে মেটেনি, রক্তের খোঁজে নিষ্ঠুর হয়েছি প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পলকে। প্রতিটি নারীর বক্ষ চিরে তার রক্তাক্ত হৃদয় স্পর্শ করলে আজ এক অদ্ভুত শান্তি যোগায়, যে শান্তি আমি পাইনি বহু হাজার বছর। হত্যা খেলায় যখন আমার শরীরের তাপ একটা রক্তাক্ত যোনি ছোঁওয়া পায়, তখন আবার সব শান্ত...... চারিদিক নিশ্চুপ।  
                                   এবার যাওয়ার পালা, আবার কোন মৃত্যুপ্রহরে লিখব তোমার কাছে, পারলে কখনো ক্ষমা করো আমায়।আমি কোন মানুষ হত্যা করিনি কখনো, আমি কেবল তাদের মুক্তির পথে ঠেলে দিয়েছি। মৃত্যুই যে মুক্তি, আমার থেকে ভালো আর কেই বা বুঝবে, মৃত্যুর আঘাতে পিঠ ক্ষতবিক্ষত হলেও জীবন কখনো আমার পিছন ছাড়েনি।
আমার যে মৃত্যু চাই, আমি আজ খুব ক্লান্ত হয়ে পরেছি এই জীবনচক্রের বোঝে। দেখি এবার যদি মুক্তি পাওয়া যায় জীবনের হাত থেকে......
ভালো থেকো বনলতা...”
-ইতি তোমার কালিদাস।।
সামনে পড়ে একটি নগ্ন মেয়ের দেহ, সে এখনও প্রাণ হারায়নি, তবে আর বেশী দেড়ি নেই। তার জামাকাপড় ছিঁড়ে তছনছ করে দিয়েছে এক অমানবিক পিশাচ। কিন্তু আজ সে নিজেও মৃত্যু খেলায় মত্ত। মেয়েটির পাশে পড়ে থাকা একটা ধারালো ছুরি দিয়ে সে নিজের হাতের শিরা কেটে চুপ করে ঘরের এক কোণে বসলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার এই জন্মের উদ্বেগ , তার চিঠি আদ্যতেও কি কখনো তার বনলতা পাবে?...... নাকি এই জন্মটা তার বাকি জন্মের মতোই ব্যর্থ রয়ে যাবে। সে যে হত্যা করেছে কেবল চিঠি পৌছনোর জন্যে ওই স্বর্গে, যেখানে সে আর কোনোদিনও যেতে পারবেনা। সে যে এই চিঠির মতো আরও তিরিশটি চিঠি পাঠিয়েছে তার প্রিয়াকে, যে অলকাপুরীতে তার অপেক্ষায় যুগের পর যুগ খাওয়া-ঘুম অবহেলা করে চলেছে। আর...মেঘ হয়ে আদ্যাও কি পারবে এই সামনে পড়ে থাকা মেয়েটির আত্মা কখনো প্রিয়ার কাছে চিঠি পৌছতে?... দেওয়ালে ঝোলা যীশু ছল ছল চোখে তখনও তাকিয়ে...






                                   





বিমূর্ত


দূর থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে আসছে,যে শব্দ আমাকে খুব একা করে দেয়,যে শব্দ আমার সামনে দিয়ে রোজ হেঁটে যায়৷ ছোটবেলা মনে করতাম মৃত্যুর শব্দ কান্না ছাড়া আর কি ই বা হতে পারে?....
বয়স বাড়তেই দেখলাম কান্না কেবলই মৃত্যুধ্বনি, মৃত্যুর সুর আদতে শেষ নিশ্বাস হতে পারে৷
ঘরটা একটু অন্ধকার করো, বড্ড আলো যে.....
আবার ঝর উঠেছে বেলা করে, কেমন অন্ধোকার হয়ে এসেছে চারিদিকে দেখ৷
আজ বোধহয় যক্ষের ঘরে ফেরার পালা, প্রিয়াকে একটিবার দেখবার জন্য সে প্রতি মুহূর্তে একাকীত্বের সাথে লড়েছে৷ হোক না দেড়-দু হাজার বছর, অলকাপুরীর প্রিয়া আজও তার অপেক্ষায়৷
চুপ মেঘ চুপ, আজ তুমিও মজা নিচ্ছ?
আমি কিন্তু হার মানিনী এখনো৷৷
কিন্তু কিন্তু, আমার লড়াই কার সাথে?
মনে পড়েছে,
আমার লড়াই যে তোমার সাথে, তাই রক্তপাত ছাড়াই ক্ষতর বিছানায় প্রতি রাতে কাতরাই আমি৷
আমার মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে , তুমি যাও এখন৷ আলো চাইনা আমার,আমায় দু ক্রোশ অন্ধকার দাও৷
ওই, আছ?
আমার বড্ড নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে, যেন আবার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরছে দায়িত্ব আর আমার পায়ে শিকল বেঁধেছে হতাশা৷ একটু শান্তির দানা এনে দেবে হোমেওপ্যাথির শিশিতে?
শোনো প্রিয়া, যদি মেঘ হয়ে ডানা মেলতে পারো, তাহলে তোমার হাতেই পাঠাব তোমায় লেখা এই চিঠি৷ কথা দাও তবে একটা, মেঘ হয়ে তুমি এ চিঠি পড়বেনা৷ পারলে পড়ো আবার জন্ম নিয়ে আমারই চোখে, আমি থাকব ৷ আমি থাকব৷৷
শুধু এবার বিদায়ের পালা, আসি তবে?
চলি বনলতা,
খেয়াল রেখো৷৷

এভাবেও ঘরে ফিরা যায়...

চোখ খুলেই দেখলাম একটা মেয়ে বসে চুপ করে, কান দিয়ে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে তার আর মিলিয়ে যাচ্ছে মেঝের নীলাঞ্জনে৷ আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি, নাকি দেখতে চাইনি?
সেও কি আমার ভিতরে লুকিয়ে থাকা পাষাণের শিকার৷ মাথার মধ্যে এত কথা-প্রশ্ন চলতে থাকার মাঝে হঠাৎ দেখলাম তার গলার একপাশে একটা কার্ড ঝুলছে৷ একটু ভাল ভাবে দেখতেই বুঝলাম সেটাতে এই মর্গেরই একটি নম্বর বসানো৷ চমকে উঠলাম,চেয়ার থেকে উঠে এগোতেই মেয়েটি উধাও৷ কিন্তু ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবেশের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলাম৷ বাঁদিকের ঢাকা পরে থাকা মৃতদেহরা যেন চিল্লিয়ে উঠল৷ তারপর আবার শান্ত চারিদিক৷
সবে রাত দুটো তখন, ভাবলাম ঘুম চোখে কি দেখতে কি দেখলাম,দিয়ে আবার চেয়ারে বসে চোখ দুটো বন্দ করলাম৷ কিছুটা অস্থিরতা মনে কাজ করলেও ,রাতের ঘুম তাকে গ্রাস করলে৷ তবে আবার সেই ফিরে আসা আর চলে যাওয়ার লড়াইয়ে জড়িয়ে পরলাম৷ চোখ খুলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম দেওয়ালের দিকে৷
বেশ কিছুদিন ধরে একটি চরিত্রের দিকে আকর্ষিত হয়ে চলেছি, এমন একজন যে কথা বলেনা, ফিরে দেখে না সে,তার সময় থমকে দাড়িয়েছে৷ আর তার সাথে থমকে দাঁড়াবার চেষ্টায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু বরণ করেছি আমি৷ আমি চোখের সামনে শেষ নিশ্বাস ফেলতে দেখিনি কাউকে কখনো, কিন্তু আমি বাস করেছি তাদেরই মাঝে এক নিশ্বাস- প্রশ্বাস হীন ঘরে৷ কিন্তু কখনো ভাবতে পাড়িনি যে মৃত কখনো মৃত্যুকে ভালবাসিয়ে তুলতে পারে৷
না আমি কোনো মর্গে কাজ করিনা,তবে নিজস্ব মর্গের মালিক৷ আমি খুনি, কিন্তু আমি কোনো কারনে কাউকে কখনো মাড়িনি৷ আসলে আমার এই পৃথিবীতে পা রাখা মৃত্যুরই হাত ধরে৷ যে মায়ের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে চলা শুরু করেছিলাম এই পৃথিবীর পথে,সেই মাকে আমি কখনো দেখিনি৷ অনুভব করতে শেখার মুহূর্ত থেকেই আমায় কাছে টেনেছিল মৃতদেহের গন্ধ৷ যেন কত না পাওয়া, কত রাগ-অভিমান মিশে সেই গন্ধে৷ এই গতিশীল সমাজ আমায় অনেক আগেই ত্যাগ করেছে,তাই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি এই মৃতদের ভিড়ে৷ আমি বেঁচে থাকতে মানুষ মারি ,
আমি জলের পিপাসায় মানুষ মারি
আমি মারব বলে মানুষ মারি৷
আমার বনলতা আমায় চেনেনা,কিন্তু আমি তার দিকে চেয়ে রই পলকহীন দৃষ্টিতে৷ আর শুধু ভাবি , কবে তাকে গিয়ে বলব,
"আমায় মৃতসঞ্জীবনী বশ করতে ব্যর্থ শুধু তোমারই কারণে..."
তার চোখে আমি কখনো একফোটা ভালবাসার ছোঁয়া দেখিনি,তবু ভেবেছি সে ই ভালবাসার আধার৷
এত চিন্তাভাবনার মাঝে আবার দেখি চেয়ারে ফিরেছে সেই মেয়েটি৷ এখনো রক্তের ধারা একটুও কমেনি , এখনো জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা কিছুটা জমেনি মানিয়ে নেওয়ার খাতায়৷ চোখ পরলো তার হাতের দিকে, রক্ত চুইয়ে পড়ছে তার হাতের ছুরি থেকে৷ অন্যদিকে তাকাতেই দেখি আমার বনলতা বসে, আজ সে সেজেছে আমায় নিয়ে যাবে বলে তার সাথে৷ মন বললে, "তাহলে আর দেরি কিসে?..."
কিন্তু.. ছুরিকাঘাত নতুন কোথায়,আমি তো রোজ খেলেছি তাকে নিয়েই....
তবে নিষ্ঠুর কিছু?
ছুরি দিয়ে তারপর আঘাত করতে থাকলাম নিজেরই মাথায়৷ রক্ত ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পরল সারা মেঝেতে৷ আর দূরে বাজচ্ছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের "মহিষাসুরমর্দিনী"৷
এভাবে অসুর মারা যায়,
এভাবেও দেবীপক্ষের আগমনী ঘটে৷৷
শুধু মৃত মন প্রতিবাদ জানিয়ে বললে,"বনলতা,এভাবেও তোমার কাছে যাওয়া যায়,
এভাবেও ঘরে ফেরা যায়...."৷৷

(THIS PIECE OF WRITING HAS BEEN  PUBLISHED IN HATPAKHA ONLINE MAGAZINE ON 24TH FEBRUARY,2018.)
Hatpakha Link

কাল দিতে পারি

আমাদের কখনো আজ ছিল না,
প্রতি মুহূর্তে কাল আর কাল ছিল,
আজ ঠিক ততটা ছিল যেখানে মানুষ ছিল প্রতি পদে,
আজ আর নেই...

কখনো বেনিয়াটোলা মোড়ে সাইকেলের চাকার জবুথুবু,
কত পথ একলা হেটে ব্যয় করেছি,
কত স্মৃতির পাতার খরচে তোমায় এঁকেছি,
সব কাল ছিল, আজ বলতে দিতে পারি কেবল কিছু শুন্যতা।

আবার কখনো আহিরীটোলায় একলা বসে থাকা বিকেল,
সেখানে বিকেল সৌন্দর্য গায়ে নদীর পারে আলতা মাখে না,
তবু শান্তি জোগায় ঘরে ফেরা মজদুরের ক্লান্তিতে,
তাদের অবেলার দু-মুঠো ভাতের দীর্ঘশ্বাস তোমায় দিতে পারি।

শ্মশানের চারিপাশে ঘুরেছি ধোঁয়া হয়ে প্রতি জন্মান্তর,
মিশে গেছি আবার চৌরাস্তার দমকলের আগুনে,
আগুনই আজ শান্তি খোঁজে এই দৈনন্দিন ভেজা সহর,
তুমিও হয়তো শান্ত আজ, শান্ত কবরের চারিপাশে ||

আমি

শ্মশানের দেবদারু গাছ আজ নীরব সাক্ষী কতো জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের। সারা শ্মশান জুড়ে কেবল সে নিজেই প্রাণ সঞ্চার করেছে আর কেঁদেছে প্রতি অগ্নিশিখায় পুড়ে যাওয়া আপন জনের ব্যথায়। ছোট বেলা থেকেই খুব কাছ থেকে দেখছিলাম এই দেবদারু গাছটিকে।ক্লান্ত এক সদ্য পিতা হারানো মেয়ে সেদিন গাছটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, তার বাবার কঠোরতা সে খুঁজে পেয়েছে গাছটির মধ্যে। কোন এক বিকেল বেলা, যখন সমস্ত শ্মশান শান্ত, আগুনের ফুঁপিয়ে ওঠার কারণ নেই, আর নিচে গঙ্গা ঘাটে মৃদু হাওয়া দিয়েছে, তখন দেবদারু গাছটি দুলেছে মৃত্যু-রচনার খেলায়। গাছটি সকলকে চিনত, সে প্রতিটি পুড়ে যাওয়া মানুষের আপন জন। তাকে খুব একটা কেউ পাত্তা দিত না। কেবল কখনও রোদ থেকে বাঁচতে আর কখনও নিজের দুঃখ দূর করতে তার নিচে দুদণ্ড বসত মানুষে।

তার কেবল একটাই সঙ্গী ছিল, তাকে সে দেখেনি কোনও কালে, কেবল দূর পশ্চিম থেকে মাঝে মাঝে সে ডাক শুনেছে তার আপন জনের। তবে দেখা হয়েছিল তার সাথে, এক অন্ধকার অহেতুক রাতে স্বপ্নের অলংকারে। দেবদারুর সঙ্গী আর কেউ নয়, আমি ই ছিলাম। আমি জীবিত নই, তবু জীবন এখনও আমার হাত ছেড়ে দূর জলাশয়ে স্নিগ্ধ হতে চায়নি। বৃষ্টির রাতে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া গাছটির সাথেই যেন মৃত্যুকে গলায় লাগিয়েছি নিজের মনে করে। ছোট থেকে অনেক দৌড়েছি , কখনও দৌড়েছি প্রতিশোধে আবার কখনও দৌড়েছি প্রতিযোগী রূপে। হাঁটার সুযোগ পাইনি কখনও সেরকম ভাবে, তাই পথের আশেপাশে সবটাই অচেনা-অজানা ছিল। কিন্তু আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো যেদিন ব্যর্থতা আছড়ে পড়লো, সেদিন জীবনের গতিবেগ উধাও হয়ে গেল। তারপর শুরু হল নতুন করে চেনা, চিনলাম পথের ধারের জীবনকে। হাঁটতে হাঁটতে একদিন পৌঁছলাম শ্মশানের কাছে। দূর থেকে তখন ডাকছে দেবদারুর ছায়া আর কালো ধোঁয়া।

দৌড়োতে দৌড়োতে কত ইতিহাসের রক্তাক্ত পাতা উলটেছি হতাশায় , দৌড়োতে দৌড়োতে রাজনীতিকে রক্ত শুষে নিতে দেখেছি প্রতি পলকে। ৭০ সালে হঠাৎ একদিন দেখলাম দৌড়ে চলা আর নয়, ঘুরে দাঁড়ানোকেই লড়াই  বলে। বন্দুকের গুলিতে কানে তালা ধরিয়ে দেওয়া প্রতি মুহূর্তে জীবন হারিয়েছে কত নিরীহ। পেন হাতে শেষ চিঠি লিখেছে কত কবি , আর গলায় দড়ি দিয়েছে নাটকের সেট।
কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ছিল যে,
নাহ, ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই তাদের কোমর ভেঙে দেয় রাজনীতি, আর বাকি কাজ করে দেয় ব্যর্থতা।

আমার বনলতা,
তাকে দেখেছিলাম যখন সে হাজারো পুরুষদের মাঝে একা ধেয়ে এসেছিল নারী শক্তি রূপে। সে মনের দিক থেকে আমার থেকে ঢের শক্ত। আমি কোন কালে শক্ত মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়নি। এই বনলতা একদিন আবার হারিয়ে গেল। আসলে তার বোধ হয় কালিদাসের কবিতা পছন্দ কেবল, কালিদাস নয়।
তারপর আবার দৌড়, এবার দায়িত্বের দিকে।আসলে বয়স বেড়েছে, কিন্তু সত্যি কি তাতে কোন যায় আসে?
পথে ছুটতে , আবার দেখা বনলতার সাথে।সে তখন আমার অপেক্ষায় চোখ ভেজায়নি।সে অপেক্ষায় তার দ্বীপ হারানো নাবিকের।চারিদিকে পুড়ছে যখন হাজার চিতা, আর সে সকল চিতার মাঝে লাল শাড়িতে উল্লসিত। হয়ত তার প্রেমিকের খোঁজ মিলেছে এই মৃত- পুরীর অন্তরালে।
ভালবাসা আর হয়নি তারপর, আজ যখন আবার হেঁটেছি একই পথ ধরে, প্রতি মুহূর্তে প্রেমে পড়েছি সেই সাঁওতাল মেয়েটির যার নাম অলকা হতে পারত। তার রূপ আমায় প্রতি মুহূর্তে এক নির্জন সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কোন এক প্রাচীন মণি-মুক্তোর দেশের মতো রহস্যের স্বাদ দিয়েছে।
আর তার হাসি?
শরতের বার্তা বয়ে এনেছে প্রতিক্ষণে। 

কিন্তু…
আবার সেই চারিদিকে আগুন লেগেছে, আবার পুড়ছে সহস্র দেহ, এবার কারণ কি?
এবার কারণ হয়ে দাড়িয়ে ধর্ম।
চারিদিকে ধর্মের নামে মৃত্যু খেলায় মেতে হাজার হাজার ছেলে, এরা কি আদোও ধর্ম বোঝে?
আর সব কিছুর মাঝে ঠিক পাঁচ মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে পুড়ছে আমার সেই সাঁওতাল দ্রৌপদি যাকে চোখে হারিয়েছি বহুদিন।কিন্তু তার এই অবস্থা দেখে এগোতেই , সে বাধা দিল…
সে বললে, “ আর বাঁচতে চাই না, ঢের হয়েছে… নারী হওয়ার শাস্তি আমি পেয়েছি…”
অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম আমার ভালবাসার মৃত্যুর দিকে । তারপর চোখ পড়লো তার ছেঁড়া পোশাকের একটা অংশের দিকে। সেটা উড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল, আর তখনই দেখলাম হত্যাকারীর মুখ, সে পাষাণের থেকেও ভয়ঙ্কর।তারপর ধর্ষণ হয়েছে কত দ্রৌপদি প্রতি অন্ধকার রাস্তায়,তাদের পুড়ে মরতে হয়েছে আরও কত স্ট্রিট ল্যাম্পের রাস্তার মোড়ে।
আর ঘুরে দেখিনি কখনও কোন নারী মূর্তির দিকে…তারা চিরকাল আমায় হতাশ করেছে।

আর দেবদারু গাছটি?
সেও আমার মতোই সাক্ষী সহস্র মৃত্যুর, তাকে বলবার আর কিচ্ছু নেই নতুন করে। আর কিছুক্ষণ, তারপর আমাকেও চলে যেতে হবে এই দেবদারু গাছের ছায়া ছেড়ে।

হঠাৎ ডাক পড়লো দূর থেকে, “ এবার আপনাদের মরা পোড়ানোর পালা…”
ব্যাস… সব শেষ, চারিদিকে স্থির আর আমি এগিয়ে চলেছি অনন্তের ডাকে।
নাহ্।। এখনও আমাকে দেখা যাবে, শ্মশান থেকে উড়ে যাওয়া কালো ধোঁয়ার দলে।
হয়তো পরিচয় দেব তখন দেবদারুর বন্ধু রূপে।

আমি তরুণাভ,
আমি অতীত ।।

আমার গল্প

জুলাই মাসের ঠিক শেষ চলছিল, আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে মাটিতে প্রতি মুহূর্তে। ছাতা হাতে সাইকেল চালিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম কেমিস্ট্রি স্যারের বাড়ি। বৃষ্টির ছাটে জামা কাপড় প্রায় ভিজে চুপচুপে, রক্ষে কেবল মাথায় জল লাগেনি। পচা ড্রেনের জল রাস্তায় উঠে চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে আর সেই বিরক্তির সাথে তাল মিলিয়ে কোথাও যেন কেঁদেই চলেছে এক পরিবার।কিছুটা এগিয়েই চোখে পড়ল একটা বাড়ির উঠনে ত্রিপল টাঙ্গান আর মেজেতে শুয়ে রয়েছে বছর ২৫য়ের একটা ফুটফুটে ছেলে। ভাল করে দেখলাম তাকে ছাতার আড়াল থেকে, নিঃশ্বাস পড়ছে না আর।পাশে একটা কাঠের বাক্স রাখা যেটার মাপ ছেলেটার শরীরের মাপেই বানানো বলে মনে হল।
একটু ধরেছে বৃষ্টিটা তখন,ছাতা বন্ধ করলাম সাইকেল থামিয়ে।পাশে কিছু লোক বলাবলি করছে শুনলাম ওই ছেলেটিকে নিয়ে। শুনলাম গলায় ফাঁস লাগিয়ে নিজেকেই হত্যা করেছে ছেলেটি।
কিন্তু কেন?

সেদিন আর পড়তে যাওয়া হল না, জানিনা কেন আমি বেশ জড়িয়ে পড়েছিলাম নিজের ভাবনা চিন্তায়। ভাবনা –চিন্তা বলতে কেবল দুটো প্রশ্ন…
কেন এ আত্ম্যহত্যা?

আর আত্ম্যহত্যায় কি হত্যাকারী শাস্তি পায়না?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেতে বেশি দেরি না হলেও, শেষের প্রশ্নটি বোধ্যয় তুলে রাখা ছিল আজকের জন্য। আত্ম্যহত্যার কারন হিসেবে পাওয়া গেল এমন কিছু যা সারাধরনত আত্ম্যহত্যার কারন হয়ে উঠতেই পারেনা।কিন্তু, এ পৃথিবী যে চিরকাল বিচ্ছেদ গাথা লিখতেই জীবিত, এখানে জীবন বলতে যে শুধু কিছু নিয়ম কানুন আঁকড়ে বেঁচে থাকা নয় সেই চিন্তা ধারার থেকে মানুষের বিচ্ছেদ অনেক আগেই ঘটে গিয়েছিল।তবু যারা এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারেনি, তাদের সহ্য করতে হয়েছে পৃথিবীর থেকে বিচ্ছেদ। ঠিক এরকমই ছিল এই আত্ম্যহত্যার কারণটা...
ছেলেটি থাকতে পারেনি একটা বন্ধ ঘরে, যেখানে আলো ঢোকে না দুপুর বারোটায়ও, সে নিরুপায়। সে কেবল শ্যাওলা পড়া দেওয়ালে যীশুর ছবির দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকে, যেন কোন নারী তার চোখের কাজল মুছছে আয়না দেখে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল ছেলেটি স্কুলে পরতেই।হয়তো তাকে সহ্য করতে হয়েছিল কোন অত্যাচারী মাস্টারের ছড়ির ঘা, বা কোন এক দূর দেশের পরীর প্রতারণা।
আচ্ছা সব সমায় আমরা সব কিছু এতো কঠিন করে ভাবি কেন?
এরকম কি হতে পারেনি যে চোট পেয়ে সে ভারসাম্য হারিয়েছিল ?
কিন্তু এরকমও তো হতে পারে যে তার মানসিক ভারসাম্য হারানোর কারণও আত্ম্যহত্যা ছিল?
হয়তো কোন এক অজানা কারণে সে আত্ম্যহত্যা করতে গিয়েই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আজ সে সফল...
পেড়েছে তার ষড়যন্ত্রকে কেউ আটকাতে?...

দ্বিতীয় প্রশ্নটা বিশেষ মনে ছিল না এতদিন , তবে আজ মনে করতে হল। আসলে এটা মনে পড়ারই ছিল একদিন।

আমার শেষ চিঠিটা আমার মা পড়েছে?
বড্ড কাঁদে মা...
চিঠি লিখেছি তো জবাব পাব বলেই, বোকা মহিলাটি এটাও বুঝল না।।সেদিনের সেই প্রশ্নের জবাব আজ নিজেই দিচ্ছি আমি...
আমার প্রয়োজন নেই সেই প্রশ্নের উত্তরের তবে দরকার আছে আগামীদের।
হ্যাঁ আমি নিজের হত্যা করেছি। জানো ছোটবেলা থেকে দেখেছি নিজের গায়ে নিজে মাড়লে লাগেনা...
সত্যি লাগেনা?
নাকি ওগুলো কেবল অভিনয়? কখনও সজোরে একটা ছুরির আঘাতে নিজের হাতের শীরা কেটে রক্ত বেড়তে দেখলে বোধহয় বোঝা যাবে কেবল সেটা।
রক্তের গন্ধ অনেকটা বারুদের মতো, খনিকে ধ্বংস করে দিতে পারে একটা পরিবারকে, উজ্রে দিতে পারে সেই নিয়ম কানুন বাঁধা জীবনকে। আত্ম্যহত্যায় হত্যাকারীকে সব থেকে নির্মম শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করতে হয়। তাকে বসে নিজেরই মৃত্যু-খেলা দেখতে হয় আর দেখতে হয় তার মা কে। তার মা ভেঙ্গে পড়েছে মাটিতে,ঠিক যেন শ্রাবণের সূর্যাস্তে ঝমঝমে বৃষ্টির মতো। কিন্তু মা গো...
দোষ তো আমার ছিল না।
দোষ ছিল জীবনের, দোষ ছিল গায়ের রক্তে, যে রক্ত আমি রেখে এসেছি আমার ঘরের মেজেতে...
দোষ ছিল আমার কেবল নিচু জাতিতে জন্মগ্রহণ করা, তাই শুধরে নেওয়ার চেষ্টায় আজ যেতেই হল। বাড়ির গেট দিয়ে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমার দেহ, পাশে দাড়িয়ে এক অচেনা লোক বলে উঠল, “ তোমার শেষ যাত্রা, আবার প্রথম থেকে শুরু...”
তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছেনা, তাকে কেউ চেনেনা...
আমি চিনি।।
জিজ্ঞেস করলাম,” তুমি সেই ছেলেটা না??”
সে কেবল হাসল।

আসলে বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা , মুক্তি... এসব কিছুর ঊর্ধ্বে শুধু একটা কথা বলতে পারি...
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য কেবল একটা ছোট্ট আলোর উৎসর। মৃত্যু মানে একটা অন্ধকার ঘরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকা আমি।


অপদার্থ

মেসে থাকতে একটা দাদার মুখে সর্বদা শুনতাম,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না...”।তাকে সেরকম কেউ পাত্তা দিত না,সারাদিন নিজের মতোই দিন কাটাত সে।তার শুনেছিলাম নার্ভের রোগ আছে কিছু, তবে আমি তাকে কখনও সেরকম ভুগতে দেখিনি। চোখে চশমা, কিছুটা আঁতেলগ্রস্থ চেহারা আর আস্থমার রোগে কাবু কিন্তু দিনে দুবার সুখটান চাই – চাই, এরকম ভাবেই চিনতাম তাকে। তবে তার বিশেষ গুণ ছিল,তার জ্ঞান,তাকে দেখে ভারী লোভ হত তার এই গুণটা পাওয়ার। মধ্যরাতে মাঝে সাঝে তর্কাতর্কিও হত ভিন্ন মতামত পেষ করার দায়ে আবার মাঝে সাঝে এক গাল হাঁসিতে শেষ হত দিনটা।
আমাদের মেস ছেড়ে তাকে একদিন চলে যেতে হয়, কারন তার বাবার হুকুম।তার বাবা পরিষ্কার জানিয়েছে তাকে যে যদি চাকরির পরীক্ষার জন্য খাটতেই হয়,তালে বাড়িতে থেকেই খাটো, বেকার মেসে থেকে টাকা ধ্বংস করে কাজ নেই।
সে চলে যায় একদিন খুব ভোরে মেস ছেড়ে, আবার সেই নিজের বাড়িতে যেটিকে সে জেলখানা বলেই মানত, আর বাবাকে ভাবতো সেখানকার ওয়ার্ডেন্ট। আসলে তার বাবারও দশ ছিল না। ছেলে শরীরে আর বয়সে বড় হলেও তার এখনও মস্তিষ্কের বৃদ্ধি খুব একটা ঘটেনি বলে সে মনে করে। তাই দিনে দশবার টেলিফোন খোঁজ নিত তার।
সেদিন মধ্যরাতে যখন সে বলেছিল আমায় ,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না…” সেদিন খটকা লেগেছিল একটা।
ছেলেটির প্রতি কথার মধ্যে একটা বিদ্রোহের ইঙ্গিত থাকত,আর সেটার স্লোগান ছিল তার মনের কোন এক কোণে সহস্র দেসিবেলে চিৎকার করতে থাকা, “একবার বুঝতে চাইলে না বাবা…”

কেটে গিয়েছে আজ বেশ কিছু মাস তার মেস ছেড়ে চলে যাওয়ার। তিনতলার চিলেকোঠার ঘরে থাকত সে, একাই থাকত। মাঝে সাঝে নিচে শুতে আসতে বললে ,বলতো, “ভাই,আমার ঠিক অন্য বিছানায় ঘুম আসবেনা”।।
পরশুদিন ভোর বেলা মেসের ছাঁদে বসে আছি, আকাশে মেঘ ছেয়ে গিয়েছে চারিদিকে যেন দিকে দিকে সহস্র প্রিয়ার অপেক্ষা মেটাতে তারা আজ প্রখর। একটা মৃদু বাতাস বয়ে চলেছে চারিপাশে,থিক যেন বহু যুগ পর কোন মৃত রাজার কাল-কোঠরি থেকে মুক্ত আজ সহস্র আত্মা।তারা যেন এই আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে নতুন রাগের আবিষ্কার ঘটাচ্ছে আর সেই রাগ ভেসে আসছে দূর থেকে, হয়তো কোন সমুদ্র সৈকত থেকে। যেখানে এক যোদ্ধা মৃত্যু কাছে পরাজিত হওয়ার আগের মুহূর্তে বেঁচে থাকা পালন করছেন সমুদ্র গর্জনে।
কিন্তু এসবের মধ্যে সেই আমার মেসের হারিয়ে যাওয়া দাদা কোথায়? তাই তো?

সে আছে তো, ওই যে আজ এক মৃত রাজার খাঁচা থেকে উরে গিয়েছে কিছু আত্মা, পাখির মতো ডানা মেলে।তার মধ্যেই ভালো করে খুঁজলে পাওয়া যাবে তাকে। তাকে বেধে রাখতে অক্ষম আমাদের সমাজ যে আবার এখন ব্যস্ত কিছু নতুন আত্মার ওপর কব্জা করাতে। যে এখন উন্মাদ কিছু হাজার মানুষের আত্মাকে কাল-কোঠরিতে পিষে মাড়তে।
কিছুদিন আগে বাড়ি ফিরেছিলাম, তখনই বিকেলে আড্ডা মাড়তে গিয়ে শুনি দাদা আর নেই। এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা যে সে সকালে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে কলেজের মাঠের শেষ প্রান্তে, যেখানে কেবল দুটি গাছ মাথা তুলে দাড়িয়ে, তার তলায় বসেছিল এসে।
আর সেখানেই বসে সে বিষপান করে।
সেদিন ছাঁদে দাড়িয়ে পাশের বাড়ির ছাঁদের দিকে যখন তাকালাম, ঠিক যেন আমার সেই দাদা বসে গাছের তলায়, হাতে একটা শিশি , আর চশমা চুইয়ে পড়ছে জল,তবু মুখে হাসি।
তার দেহ পরে লুটোচ্ছে মাটিতে, গাছের তলায় আর মুখ দিয়ে অহরহ গ্যাঁজলা উঠছে।তার বিদ্রোহ সেদিনই শেষ, তবে...
লোকে তবুও বলবে বিদ্রোহীরা আত্মহত্যা করে না, তারা লড়ে যায়।
কিন্তু তখন যদি আমি বলি,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না...”



আশ্লেষা




বত্রিশ বছর পর,
বইয়ের টেবিলে পুনরায় মোমবাতি গুনব,
গুনবো শত রাত কাটানো অন্ধকার চিত্ত,
গুনবো শত নারী হত্যাকাণ্ড মোমবাতির আলোতে,

 আবার বত্রিশ বছর একদিন,
তোমার মায়া আজ বেসিনে ধুয়েছি,
প্রত্যেক মুহূর্তে তোমা হতে বহু দূরে শরে চলেছি,
জানালার পাশে ঝুলছে নাইলন যে দড়ি,
সেই ভালোবাসার নাইলন দড়ি সর্পগুণে গুনিত,
আজ কত প্রাণ শান্তি পাবে তোমার পশ্চাতে,
হত্যা সেদিন করিনি আমি...
করেছে আমার পাষাণ...
আমি নির্দোষ ,
আজও স্বপ্ন তোমার মৃত্যু-জোছনায় মেতে,
কলমের শেষ আঁচর তাই রক্ত মাংস শরীরে,
রক্তে ভেসেছে সেই বিষ টান...
কালো-রক্তে সারা ঘর কলঙ্কিত হয়েছে,

মোমবাতি নিবিয়েছি আবার কাতর রক্ত-গর্ভে,
মরীচিকাময় মৃত্যু-খেলায় শত মোমবাতির আলো মিথ্যে,
মিথ্যে ঊর্ধ্বাঙ্গে চলাচল,
হত্যাকারী-পাষাণ আমাকে মেরেছে প্রতিনিয়ত,
হস্তরেখায় হত্যা-তোমার দগদগে রক্ত মাখা,

মৃত্যু তুমি অগস্ত্যযাত্রা,তুমি আমার আশ্লেষা।।

হেমন্ত



খাতা খুলতেই প্রথমে চোখে পড়লো রয় হ্যচটনের লেখা চারটি লাইন...
মৃত্যু আমার কাছে খুব স্বাভাবিক আর,
একদিন আমায় কবর দেওয়া হবে কোন এক পাথরের নিচে,
আর তখন সেটা অস্বাভাবিক কিছু হবেনা...
জীবনের মতই স্বাভাবিক হবে মৃত্যু...

খাতাটি বন্ধ করে তাকালাম আয়নার দিকে, গালের দারিগুলো বেশ বড় হয়েছে, ওজনটাও বেড়েছে বলেই মনে হল। চুলে পাক ধরেছে আর গায়ের চামড়াও কুঁচকে গিয়েছে।আসলে অনেকদিন সূর্যের আলোর সাথে সম্পর্ক ছিল না কোন। কেবল চার দেওয়াল আর তাতে পাথরের আঁচর।ভেন্টিলেটরের মধ্যে দিয়ে দেখতে পেতাম কেবল একটা গাছ, আর হেমন্তের ঝরা পাতার আওয়াজ ধেয়ে আসত আমার দিকে।আর মাঝে সাঝে আসত গাছের গায়ে পাথরের আঁচরের শব্দ।

কিছু বছর আগে বেশ চলছিল জীবনটা, পত্রিকায় লিখে দিব্বি পেট চলে যাচ্ছিল। বাড়িতে লোক বলতে স্ত্রী আর মেয়ে। মেয়েটির বয়েস তখন ৫ বছর।ফুটফুটে পুতুলের মতো সারাদিন ঘুরে বেড়াত সারা বাড়ি।আর স্ত্রীয়ের সাথে সপ্তাহে একবার বচসা লেগেই থাকত। আমার রাত পর্যন্ত কাজ থাকত,তাদের সারাদিন একাই থাকতে হত।তবে সপ্তাহের শেষে ঘুরতে বেড়ানোর পালা আসত,তখন বেশ সব রাগ-ঝাপ ধুয়ে মুছে যেত,ঠিক যেন স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোকে চুম্বন করেছে বর্ষার আদ্রতা।

সবে গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে , হেমন্তের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী । তুচ্ছ খাদ্য- যন্ত্র গুলো সেদিন একে-একে পরে মিশে যাচ্ছিল মাটির সাথে। যেন আত্মহত্যা আগে শেষ কাছের মানুষটিকেও দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্র। হেমন্তের ঝরা পাতা যেন মানব সমাজেও অভিশাপ বয়ে নিয়ে এলো আর নিমেষে যক্ষের প্রিয়ার খবর এনে আছড়ে ফেলল আমার ঘরের উঠনে।
হেমন্ত, এ তোমার কাজ,মেঘ দিব্বি অলকাপুরির দিকে ছুটে চলেছিল।

 রাতে খবর এলো ,আর চাকরি নেই
কাল রাত্রে কোন এক অজানা দুর্ঘটনায় পত্রিকার প্রিন্টিং কারখানা ও অফিস দুটোই পুড়ে ছাই।পরদিন সকালে ঘটনা স্থলে গিয়ে দেখলাম হেমন্তের আত্মত্যাগের গন্ধে মেতে উঠেছে চারিপাশ। আবার সেই খাদ্য-যন্ত্রেরই বলিদান এখানেও। আর
আসলে বলিদান কথাটা এখানে সামাজিক, যদি সত্যি দেখতে হয় চোখ ফেরাও একবার হেমন্তের নেরা গাছের তলায় বসে থাকা ওই মায়ের দিকে যে নিজের বাচ্চাকে আঁচলের নিচে স্তন্যপান করাচ্ছিল।মাথার উপর তার ছায়া নেই, তাকে প্রতিপদে হতাশার সাথে হাসি মুখে চলতে হচ্ছিল , “কেমন আছ?” প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে।
তার উত্তর সে দিয়েছিল...
কিছুদিন বাধে ওই গাছেই ঝুলছিল তার মৃতদেহ আর নিচে বসেছিল ছোট্ট বাচ্চাটির রূপে ফ্র্যান্সেসচিয়ালো যার চোখে মুখে ভেসে আসে কেবল একটাই কথা,
                                                               “আমার সম্মান বিক্রয় হয় না
পরের দিন ছেলেটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি আর পাওয়া যায়নি তার মধ্যের ফ্র্যান্সেসচিয়ালোকে।

আমি ওই মহিলাটির মত ভুল করিনি।সেদিন রাতেই শেষ বার কথা হয়েছিল স্ত্রীয়ের সাথে, তারপর ওদের ঘুম পারিয়ে দিয়েছিলাম। কি করে সহ্য করবে ওরা এ কঠিন পৃথিবীকে?
বরং ওদের নিদ্রা-ছন্ন করে রাখলেই ওদের শান্তি।
ওরা ঘুমচ্ছে।।
ঘুম পারিয়েছি আমি।। না আমি স্বার্থপর না...
কিন্তু আমাকে তো ওই নামেই চেনে সবাই।আমায় পাষাণ বলে ডাকে সবাই...
সবাই??

আমি ওদের খুন করিনি, ওদের শান্তি দিয়েছি। আবার বলছি, ওরা পারত না সহ্য করতে অনাহার, ওরা পারত না সহ্য করতে ভিটে-বাড়িহীন জীবন।আমি ওদের হয়ে নিজেই সহ্য করছি যে,
আমি তো কোথাও যাইনি।।

পুলিশেও নিজেই ধরা দিয়েছিলাম,আসলে অনাহারে প্রায় অর্ধ-মৃত হয়ে গেছিলাম।তারপর আজ কুরিবছর পর আবার সমাজের সম্মুখীন।
আমার বয়স এখন ৫৩, দীর্ঘ ২০ বছর পর আজ কেবল এটা মনে হল আরও কিছুদিন যদি ওই ঘরেই থাকা যেত। বেশ তো ছিলাম ওখানে আমরা তিন জন।
হ্যাঁ তিন জনই...
ওরা আসত মাঝে মাঝেই,
আমার মেয়ে, মিনি, মাথা রেখে ঘুমত আমার কোলে।কেবল তার একটা প্রশ্নেরই কখনও উত্তর দিতে পারিনি...
বাপি আমায় মারলে কেন?...”

আর আমার বনলতা...
সে আর কথা বলেনি,কেবল এক ভাবে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। তাকে দেখে মনে হত সে ভাবেনি সেই হাল ভাঙা নাভিক তাকে  দারুচিনি দ্বীপের শালীনতার থেকে একদিন বঞ্চিত করে দেবে। তার চোখের জলের প্রতি ফোটায় যেন প্রতারণায় পাওয়া গভীর বিষাদ লুকিয়ে আছে।

তুমিও বুঝলে না বনলতা ? আজ আমি যে যক্ষের বদলে দাড়িয়ে, শাস্তি কেবল একটা জন্মের।জানো আজ অলকা-পুরিতে যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে ফিরে গিয়েছে। ওদের দূরত্ব আর অভিশাপ নয়...
আর সেই ছেলেটা ,যাকে ফ্র্যান্সেসচিয়ালো বলেছিলাম সে আজ ঝুলছে ওর মায়েরই মত। গাছের গায়ে সে আঁচর কেটে লিখে গিয়েছে, ওই দেখ,
                                      “হেমন্ত আবার আসবে..."
                   












  




অমূলপ্রত্যক্ষ

"আম্মা,আমি আল্লাহর নিকট আজ নিজেকে দান করলাম..."
লেখা চিঠিতে।
মা নেই ছেলেটির,জন্ম তার অভিশাপ,
তাহলে কে তার মা?
সে লিখেছে নিজের জন্মভূমির কাছে,
মনে রেখ ,
যে জন্মভূমি জেহাদ মানে প্রাণ বোঝে,
সে মৃত্যুমঞ্চও জেহাদির ভালবাসা পায়।
জন্মের পশ্চাত সে কখনও বাবাকে দেখেনি,
তবে সে ভয়ানক বকুনি শুনেছে বেয়নেটের নলের।
তাকে কেউ কাঁদতে শেখায়নি,
সে কেঁদেছে বোমাবাজির হাহাকারে।
আজ সেও নেই...
খুঁজে দেখ সে লুকিয়ে কোনো মিথ্যে জেহাদের কবরে।।

উড়ে যাওয়া কিছু চিঠির মাঝে হাতে লেগে পরে গেল একটা,
সে লিখছে,
" ঈশ্বর, তোমার ধর্ম ব্যর্থ...
ব্যর্থ তুমি পৃথিবীর উপদ্বীপে"
সে যে এক সাধারণ নারী, তার দিন কাটে হারেমের তোসামদিতে,
তার দেহ আজ পুঁতে রেখেছে কোন দুষ্কৃতি ইরাকের সমতলে
সে লিখেছে তার ভালবাসার কাছে, যার জন্য সে বসে থাকত নদীর কুয়াশায়,
ছেলেটি হয়তো কখনও ফেরেনি,
হয়তো ফিরেছে বার বার যুদ্ধের সংবাদ, নয়তো রয়ে গিয়েছে চিরকাল একটা গাছ,
যাকে সে ভালবাসার নামে ডাকত

ঘরে খুব হাওয়া, এক-দু ফোঁটা বৃষ্টির জলও এসে পরছে গায়ে,
এক কোণে পরে থাকা একটা চিঠি হঠাৎ হাতের সামনে এসে পড়লো,
লেখা কেবল ,"ইতি স্বপ্ন..."
ছেলেটি তাহলে নেই হয়তো আজ আর,
সমাজ তাকে দিব্যি হজম করে নিয়েছে,
আর হজম করে নিয়েছে মানুষের,"লোকে কি বলবে?..."
হজম ছেলেটাও করেছে ,
হজম করেছে প্রতিপদে ধাক্কা, আর সামাজিক প্রতারণা,
জাত-পাত, ধর্ম কিছু ছাড়েনি তাকে,
হত্যা করেছে তাকে নিষ্ঠুর ভালবাসা,
সবার খাবারের থালায় সমান ভাবে রয়ে গেছিল সে,
তার মৃত্যুর প্রতিবাদও কেবল এক সামাজিক রাজনীতি৷

বাইরের বৃষ্টিটা বেড়েছে, ঘরের টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আলোও নিভে গেল,
তারপর চোখের সামনে যেন মিছিলের পর মিছিল,
নাহ, ভুল করছি,
ওই তো হালিমের ভিতর গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে একটি মেয়ে,
ওই তো মন্দিরের বাইরে খিদের জ্বালায় বিষপান করছে এক গর্ভবতী৷
আলো ফিরতেই চিঠিগুলো উধাও,
আর উধাও তারা...।।