আমার গল্প

জুলাই মাসের ঠিক শেষ চলছিল, আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে মাটিতে প্রতি মুহূর্তে। ছাতা হাতে সাইকেল চালিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম কেমিস্ট্রি স্যারের বাড়ি। বৃষ্টির ছাটে জামা কাপড় প্রায় ভিজে চুপচুপে, রক্ষে কেবল মাথায় জল লাগেনি। পচা ড্রেনের জল রাস্তায় উঠে চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে আর সেই বিরক্তির সাথে তাল মিলিয়ে কোথাও যেন কেঁদেই চলেছে এক পরিবার।কিছুটা এগিয়েই চোখে পড়ল একটা বাড়ির উঠনে ত্রিপল টাঙ্গান আর মেজেতে শুয়ে রয়েছে বছর ২৫য়ের একটা ফুটফুটে ছেলে। ভাল করে দেখলাম তাকে ছাতার আড়াল থেকে, নিঃশ্বাস পড়ছে না আর।পাশে একটা কাঠের বাক্স রাখা যেটার মাপ ছেলেটার শরীরের মাপেই বানানো বলে মনে হল।
একটু ধরেছে বৃষ্টিটা তখন,ছাতা বন্ধ করলাম সাইকেল থামিয়ে।পাশে কিছু লোক বলাবলি করছে শুনলাম ওই ছেলেটিকে নিয়ে। শুনলাম গলায় ফাঁস লাগিয়ে নিজেকেই হত্যা করেছে ছেলেটি।
কিন্তু কেন?

সেদিন আর পড়তে যাওয়া হল না, জানিনা কেন আমি বেশ জড়িয়ে পড়েছিলাম নিজের ভাবনা চিন্তায়। ভাবনা –চিন্তা বলতে কেবল দুটো প্রশ্ন…
কেন এ আত্ম্যহত্যা?

আর আত্ম্যহত্যায় কি হত্যাকারী শাস্তি পায়না?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেতে বেশি দেরি না হলেও, শেষের প্রশ্নটি বোধ্যয় তুলে রাখা ছিল আজকের জন্য। আত্ম্যহত্যার কারন হিসেবে পাওয়া গেল এমন কিছু যা সারাধরনত আত্ম্যহত্যার কারন হয়ে উঠতেই পারেনা।কিন্তু, এ পৃথিবী যে চিরকাল বিচ্ছেদ গাথা লিখতেই জীবিত, এখানে জীবন বলতে যে শুধু কিছু নিয়ম কানুন আঁকড়ে বেঁচে থাকা নয় সেই চিন্তা ধারার থেকে মানুষের বিচ্ছেদ অনেক আগেই ঘটে গিয়েছিল।তবু যারা এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারেনি, তাদের সহ্য করতে হয়েছে পৃথিবীর থেকে বিচ্ছেদ। ঠিক এরকমই ছিল এই আত্ম্যহত্যার কারণটা...
ছেলেটি থাকতে পারেনি একটা বন্ধ ঘরে, যেখানে আলো ঢোকে না দুপুর বারোটায়ও, সে নিরুপায়। সে কেবল শ্যাওলা পড়া দেওয়ালে যীশুর ছবির দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকে, যেন কোন নারী তার চোখের কাজল মুছছে আয়না দেখে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল ছেলেটি স্কুলে পরতেই।হয়তো তাকে সহ্য করতে হয়েছিল কোন অত্যাচারী মাস্টারের ছড়ির ঘা, বা কোন এক দূর দেশের পরীর প্রতারণা।
আচ্ছা সব সমায় আমরা সব কিছু এতো কঠিন করে ভাবি কেন?
এরকম কি হতে পারেনি যে চোট পেয়ে সে ভারসাম্য হারিয়েছিল ?
কিন্তু এরকমও তো হতে পারে যে তার মানসিক ভারসাম্য হারানোর কারণও আত্ম্যহত্যা ছিল?
হয়তো কোন এক অজানা কারণে সে আত্ম্যহত্যা করতে গিয়েই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আজ সে সফল...
পেড়েছে তার ষড়যন্ত্রকে কেউ আটকাতে?...

দ্বিতীয় প্রশ্নটা বিশেষ মনে ছিল না এতদিন , তবে আজ মনে করতে হল। আসলে এটা মনে পড়ারই ছিল একদিন।

আমার শেষ চিঠিটা আমার মা পড়েছে?
বড্ড কাঁদে মা...
চিঠি লিখেছি তো জবাব পাব বলেই, বোকা মহিলাটি এটাও বুঝল না।।সেদিনের সেই প্রশ্নের জবাব আজ নিজেই দিচ্ছি আমি...
আমার প্রয়োজন নেই সেই প্রশ্নের উত্তরের তবে দরকার আছে আগামীদের।
হ্যাঁ আমি নিজের হত্যা করেছি। জানো ছোটবেলা থেকে দেখেছি নিজের গায়ে নিজে মাড়লে লাগেনা...
সত্যি লাগেনা?
নাকি ওগুলো কেবল অভিনয়? কখনও সজোরে একটা ছুরির আঘাতে নিজের হাতের শীরা কেটে রক্ত বেড়তে দেখলে বোধহয় বোঝা যাবে কেবল সেটা।
রক্তের গন্ধ অনেকটা বারুদের মতো, খনিকে ধ্বংস করে দিতে পারে একটা পরিবারকে, উজ্রে দিতে পারে সেই নিয়ম কানুন বাঁধা জীবনকে। আত্ম্যহত্যায় হত্যাকারীকে সব থেকে নির্মম শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করতে হয়। তাকে বসে নিজেরই মৃত্যু-খেলা দেখতে হয় আর দেখতে হয় তার মা কে। তার মা ভেঙ্গে পড়েছে মাটিতে,ঠিক যেন শ্রাবণের সূর্যাস্তে ঝমঝমে বৃষ্টির মতো। কিন্তু মা গো...
দোষ তো আমার ছিল না।
দোষ ছিল জীবনের, দোষ ছিল গায়ের রক্তে, যে রক্ত আমি রেখে এসেছি আমার ঘরের মেজেতে...
দোষ ছিল আমার কেবল নিচু জাতিতে জন্মগ্রহণ করা, তাই শুধরে নেওয়ার চেষ্টায় আজ যেতেই হল। বাড়ির গেট দিয়ে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমার দেহ, পাশে দাড়িয়ে এক অচেনা লোক বলে উঠল, “ তোমার শেষ যাত্রা, আবার প্রথম থেকে শুরু...”
তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছেনা, তাকে কেউ চেনেনা...
আমি চিনি।।
জিজ্ঞেস করলাম,” তুমি সেই ছেলেটা না??”
সে কেবল হাসল।

আসলে বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা , মুক্তি... এসব কিছুর ঊর্ধ্বে শুধু একটা কথা বলতে পারি...
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য কেবল একটা ছোট্ট আলোর উৎসর। মৃত্যু মানে একটা অন্ধকার ঘরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকা আমি।


No comments:

Post a Comment