রোহিত-কণিকা

জুলাই মাস পড়েছে সবেসেমিস্টার শেষ করে সবে ঘরে ফিরেছিআমাদের বাড়িটা সহরের ঠিক এক কোণে,যেখানে মানুষ এখনও রাত ১০টায় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস বজায় রেখেছেরাস্তার স্ট্রিট ল্যাম্প গুলি কেবল টিম টিম করে জ্বলে সারা রাতএখানকার মানুষের আরও একটি বিশিষ্ট আছে, তারা কেবল নিজেদের নিয়ে চিন্তিতদেশ উচ্ছন্নে গেলেও তাদের খুব একটা যায় আশে না তবে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের দিন হথাত দেশের প্রতি প্রেম উদয় হয়সকালে বাজারে গিয়ে শুনলাম চারিদিকে কেবল একটাই মাথা ব্যথা,”জি এস টি
সেদিন রাতে ইউটিউবে হথাত একটা গানের মধ্যে দিয়ে পরিচয় হল এক অদ্ভুত চরিত্রের সাথে।না সে গান গায় না তবে গান টা তাকে নিয়েই। না সে খুব নামি দামি কোন শিল্পীও নন,সে সাধারণ।সে সাধারণের মাঝেও অতি সাধারণ,ধুলোর ন্যায় তার ধরন।সে বড় কোন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট নন, সে এমন একজন যার কাছে জন্ম ছিল সব থেকে বড় ভুল।তবে তুমি তাকে লেখক বলতে পারো...তবে তার লেখা বই টাও যে তোমার ভালো লাগবেনা।সে যে কেবল লিখে গিয়েছে জাত-পাত হীন সমাজের কথা। তবে তাকে তুমি দেখতে পাবে,দেখতে পাবে কার্ল সাগানের কোন এক চরিত্রে।সে ছোট বেলা থেকে কার্ল সাগান হতেই তো চেয়েছিল।
কে সে??......
আমিও তাকে চিনতাম না,আসলে হথাত চোখে পরে গিয়েছিল সে।না এবার ইউটিউবে নয়,এবার মধ্যরাতে সামনা-স্যামনইআমার বারান্দার ঠিক বাইরে জঙ্গলের সামনে যেখানে নাইট ল্যাম্প টা জ্বলে সারারাত,সেখানে তাকে দেখতে পাই।
এখনও তার গলায় দড়ির দাগটা দগ-দগে, এখনও সে কথা বলতে তড়পাচ্ছে।সে এগিয়ে এসে বললে, “তোমার ভয় করছে না?...”
আমি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক মনে দেখলাম,এই তো সে,জাকে নিয়ে ছাত্র মহল উথালপাতাল।এই তো সে যে সমাজ থেকে এগিয়ে চিন্তা করেছিল সমাজ বদলানর।এই তো সেই রোহিত ভেমুলা যাকে ইউনিভার্সিটি তাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে চিরকাল একটা প্রশ্ন এসেছে মাথায়, যে এত লড়াকু তাকে কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হল?।।
সে যেন আমার মনের এই প্রশ্নটা শুনতে পেল।সে কেবল বললে “ ক্লান্ত আমি বড্ড, একটু বসতে দেবে?” আমি দৌড়িয়ে ঘরে এসে বসতেই দেখি সে বসে আছে সামনের চেয়ারে। অদ্ভুত একটা হাসি তার মুখে, তারপর সে আবার বলে উঠল...” তুমি ভয় পাচ্ছ কাকে? একটা হেরে যাওয়া মানুষকে?...
                                         ভয় নেই, ভয় নেই...”
তাকে অল্প আলোতে দেখলাম, ঝাঁকড়া চুল আর রং বেজায় কালো,তাতে কি? তার চোখের দিকে তাকালেই তার চেহারা প্রাধান্য পায়।তার চোখে একটা অদ্ভুত আলো , যেই আলো এগিয়ে চলার প্রেরণা যোগায় দিক-ভ্রষ্ট নাভিকের দলকে। চোখের রশ্মিকনা যেন চেঁচিয়ে বলছে, “ এগিয়ে চল, এগিয়ে চল...
                                                 আমিই শেষ নই...অনেক কাজ বাকি...”
একটু ইতস্তত করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম ,” তবে কি আর কিচ্ছু করার ছিল না?...”
সে কেবল বললে,” সক্রেটিসের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই...?...”
আমি বুঝলাম কেবল যুগ বদলেছে, পোশাক বদলেছে, কিন্তু শিক্ষাকে আজও হার মানতে হয় শক্তির কাছে।
সে হঠাৎ বললে,” ঠিক ধরেছ বন্ধু, তবে কি ভুলটা আমারও , আমার জন্মটাই যে ভুলের ওপর।“
হঠাৎ মনে পরে গেল তারই লেখা শেষ চিঠির কথা
                                                         ”....fatal accident of my birth.”
গলা থেকে এক ফোটা দু ফোটা করে রক্ত পড়ছে তার, তবু আজ সে হাসছে
আমি বলার মতো কিছুই না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন কেমন আছো?...”
সে বললে,” এখন? এখন তো আমি মুক্ত , আমায় কেউ দলিত বলে হেও করে না আর, সত্যি বলতে কি, মায়ের কথা মনে পরে আর মনে পরে ভাইয়ের কথা, তারা আজও এমন এক সমাজে থাকে যেটা ওদেরই মানুষ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে যদি একবার পারতাম, একবার
দেখিয়ে দিতাম সবাইকে,মৃত্যুই  সব কিছুর মূলেজাত-পাত নেই এখানে, সবাই কেমন ঘুরে বেড়ায় নিজের মনে, মারামারি নেই,দলিতদের দিকে ইট ছোড়া নেইশুধু মা নেই,আর নেই ভাই-বোন দুটো…”
হঠাৎ সে থেমে গেলচারিদিক নি:শ্চুপ হয়ে গেল কিছুটা সময়ের জন্য

তার কথার ধরণই হয়তো কারণ,আমি নিজেকে বেশ মানিয়ে নিতে পাড়ছি বুঝতে পাড়লাম আশেপাশে যা হচ্ছে সেটার সাথেএবার আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,”আচ্ছা তোমায় নিয়ে এতো উন্মাদনা, এতো হাহাকার তোমার মৃত্যু ঘিরে সারা দেশে, তুমি কি মনে করো তোমার বলিদান সফল?”

সে মাথা নিচু করিয়ে বলতে লাগলে,” বলিদান? আমি বলিদান করিনি, আমি হেরে গিয়ে মাথা নথ করেছি এমন একটা সিস্টেমের সামনে যে আস্তে আস্তে সবাইকে গিলে খেয়ে নেবে, আর
আজ যারা অহরহ আমার নামে স্লোগান তুলছে, তারা কি পেড়েছে আমায় বাঁচাতে??...
তার আজ এগিয়ে এসেছে কারণ তারা জানে এখনই সমায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর, আর আমি?
আমাকে চাইলেও কেও জীবিত রাখতে পারবেনা,
জীবন কথাটাই আমার কাছে বিষাক্ত
জীবনের দাম বলতে কেবল একটা ভোট, তুমি রাস্তায় পরে থাকো বা বড় বাড়িতে থাকো, তোমার জীবনকে আজ এক শ্রেণী কেবল ভোট হিসেবে দেখে…”

জিজ্ঞাসা করলাম,” আর কার্ল সাগান?...”

সে বললে,” আচ্ছা বল তো কার্ল সাগানও কি দলিত ছিলেন?
                  না বোধয়।
                   দলিত হলে আজ সে কার্ল সাগান হতেন না,
                  রোহিত ভেমুলাই হতেন তিনি।
               আমি কি করে কার্ল সাগান হতাম তাহলে?”
 বাইরের বৃষ্টির শব্দে তার গলা মিলিয়ে গেল, সে আবার বললে,” জল হবে একটু?”
  বিছানার পাশ থেকে জলের বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে জেতার উত্তর আমি কিছুতেই পাচ্ছিনা।বার বার একটাই প্রশ্ন আসছে ঘুরে ফিরে,আর সেটা হল রহিত ভেমুলা নামে যে আমার সামনে বসে আছে সে এখানে কেন? কি উদ্দেশ্য তার?

সে নিজেই আবার বলে উঠল,” তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই, একবার বাইরে চেয়ে দেখ, তাহলেই তুমি বুঝবে ...”
সে চলে গেল, আর তার পিছন-পিছন বাইরে বেড়তেই দেখি ঠিক বাড়ির বাইরে সহস্র রোহিতের দেহ পরে রয়েছে,আর পাশে কাতরাচ্ছে সহস্র পরিবার তাদের।
জননীর বুকে আছড়ে পড়েছে তারই শত প্রাণ আর তারই শোকে জননীর আর্তনাদ ভেসে যাচ্ছে অলকা-পুরিতে, যেখানে আজও যক্ষের প্রিয়া তার অপেক্ষায়। কিসের শাস্তি তবে?
যক্ষ আজও বন্দী জাত-পাতের ভেদাভেদিতে, আর অলকা-পুরিতে মৃত্যুসংবাদ উচ্ছ্বাস এনে দায় সায়ানাইড হাতে প্রিয়ার মুখে,
এবার তবে মিলন সম্ভব।।
 ওদিকে প্রোজেক্টরে চলছে “মুজ্জাফারনগর বাকি হায়”
 তার সামনেও দলাদলি, মারামারি, ওটা কে ? কে মারছে ভেমুলা কে?

হঠাৎ আবার সব উধাও...
একটা চিরকুট এসে পড়লো সামনে,
লেখা,"From Shadows To The Stars..."
দৌরে ঘরের দিকে যেতেই ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাড়িয়ে চমকে গেলাম,
আয়নার ওপারে দাড়িয়ে অর্ধেক রোহিত আর অর্ধেক আমি...
একহাতে দেখলাম ফাঁস লাগানো এক গোছা দড়ি।।


  
  


2 comments:

  1. My favorite line , agiye chol , agiye chol ami hi sesh Na , onk kaaj baki .. So true .

    ReplyDelete
  2. Couldn't able to understand the word but felt the deep down meaning of it ..Great going Tarnauvo ...👍

    ReplyDelete