হেমন্ত



খাতা খুলতেই প্রথমে চোখে পড়লো রয় হ্যচটনের লেখা চারটি লাইন...
মৃত্যু আমার কাছে খুব স্বাভাবিক আর,
একদিন আমায় কবর দেওয়া হবে কোন এক পাথরের নিচে,
আর তখন সেটা অস্বাভাবিক কিছু হবেনা...
জীবনের মতই স্বাভাবিক হবে মৃত্যু...

খাতাটি বন্ধ করে তাকালাম আয়নার দিকে, গালের দারিগুলো বেশ বড় হয়েছে, ওজনটাও বেড়েছে বলেই মনে হল। চুলে পাক ধরেছে আর গায়ের চামড়াও কুঁচকে গিয়েছে।আসলে অনেকদিন সূর্যের আলোর সাথে সম্পর্ক ছিল না কোন। কেবল চার দেওয়াল আর তাতে পাথরের আঁচর।ভেন্টিলেটরের মধ্যে দিয়ে দেখতে পেতাম কেবল একটা গাছ, আর হেমন্তের ঝরা পাতার আওয়াজ ধেয়ে আসত আমার দিকে।আর মাঝে সাঝে আসত গাছের গায়ে পাথরের আঁচরের শব্দ।

কিছু বছর আগে বেশ চলছিল জীবনটা, পত্রিকায় লিখে দিব্বি পেট চলে যাচ্ছিল। বাড়িতে লোক বলতে স্ত্রী আর মেয়ে। মেয়েটির বয়েস তখন ৫ বছর।ফুটফুটে পুতুলের মতো সারাদিন ঘুরে বেড়াত সারা বাড়ি।আর স্ত্রীয়ের সাথে সপ্তাহে একবার বচসা লেগেই থাকত। আমার রাত পর্যন্ত কাজ থাকত,তাদের সারাদিন একাই থাকতে হত।তবে সপ্তাহের শেষে ঘুরতে বেড়ানোর পালা আসত,তখন বেশ সব রাগ-ঝাপ ধুয়ে মুছে যেত,ঠিক যেন স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোকে চুম্বন করেছে বর্ষার আদ্রতা।

সবে গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে , হেমন্তের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী । তুচ্ছ খাদ্য- যন্ত্র গুলো সেদিন একে-একে পরে মিশে যাচ্ছিল মাটির সাথে। যেন আত্মহত্যা আগে শেষ কাছের মানুষটিকেও দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্র। হেমন্তের ঝরা পাতা যেন মানব সমাজেও অভিশাপ বয়ে নিয়ে এলো আর নিমেষে যক্ষের প্রিয়ার খবর এনে আছড়ে ফেলল আমার ঘরের উঠনে।
হেমন্ত, এ তোমার কাজ,মেঘ দিব্বি অলকাপুরির দিকে ছুটে চলেছিল।

 রাতে খবর এলো ,আর চাকরি নেই
কাল রাত্রে কোন এক অজানা দুর্ঘটনায় পত্রিকার প্রিন্টিং কারখানা ও অফিস দুটোই পুড়ে ছাই।পরদিন সকালে ঘটনা স্থলে গিয়ে দেখলাম হেমন্তের আত্মত্যাগের গন্ধে মেতে উঠেছে চারিপাশ। আবার সেই খাদ্য-যন্ত্রেরই বলিদান এখানেও। আর
আসলে বলিদান কথাটা এখানে সামাজিক, যদি সত্যি দেখতে হয় চোখ ফেরাও একবার হেমন্তের নেরা গাছের তলায় বসে থাকা ওই মায়ের দিকে যে নিজের বাচ্চাকে আঁচলের নিচে স্তন্যপান করাচ্ছিল।মাথার উপর তার ছায়া নেই, তাকে প্রতিপদে হতাশার সাথে হাসি মুখে চলতে হচ্ছিল , “কেমন আছ?” প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে।
তার উত্তর সে দিয়েছিল...
কিছুদিন বাধে ওই গাছেই ঝুলছিল তার মৃতদেহ আর নিচে বসেছিল ছোট্ট বাচ্চাটির রূপে ফ্র্যান্সেসচিয়ালো যার চোখে মুখে ভেসে আসে কেবল একটাই কথা,
                                                               “আমার সম্মান বিক্রয় হয় না
পরের দিন ছেলেটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি আর পাওয়া যায়নি তার মধ্যের ফ্র্যান্সেসচিয়ালোকে।

আমি ওই মহিলাটির মত ভুল করিনি।সেদিন রাতেই শেষ বার কথা হয়েছিল স্ত্রীয়ের সাথে, তারপর ওদের ঘুম পারিয়ে দিয়েছিলাম। কি করে সহ্য করবে ওরা এ কঠিন পৃথিবীকে?
বরং ওদের নিদ্রা-ছন্ন করে রাখলেই ওদের শান্তি।
ওরা ঘুমচ্ছে।।
ঘুম পারিয়েছি আমি।। না আমি স্বার্থপর না...
কিন্তু আমাকে তো ওই নামেই চেনে সবাই।আমায় পাষাণ বলে ডাকে সবাই...
সবাই??

আমি ওদের খুন করিনি, ওদের শান্তি দিয়েছি। আবার বলছি, ওরা পারত না সহ্য করতে অনাহার, ওরা পারত না সহ্য করতে ভিটে-বাড়িহীন জীবন।আমি ওদের হয়ে নিজেই সহ্য করছি যে,
আমি তো কোথাও যাইনি।।

পুলিশেও নিজেই ধরা দিয়েছিলাম,আসলে অনাহারে প্রায় অর্ধ-মৃত হয়ে গেছিলাম।তারপর আজ কুরিবছর পর আবার সমাজের সম্মুখীন।
আমার বয়স এখন ৫৩, দীর্ঘ ২০ বছর পর আজ কেবল এটা মনে হল আরও কিছুদিন যদি ওই ঘরেই থাকা যেত। বেশ তো ছিলাম ওখানে আমরা তিন জন।
হ্যাঁ তিন জনই...
ওরা আসত মাঝে মাঝেই,
আমার মেয়ে, মিনি, মাথা রেখে ঘুমত আমার কোলে।কেবল তার একটা প্রশ্নেরই কখনও উত্তর দিতে পারিনি...
বাপি আমায় মারলে কেন?...”

আর আমার বনলতা...
সে আর কথা বলেনি,কেবল এক ভাবে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। তাকে দেখে মনে হত সে ভাবেনি সেই হাল ভাঙা নাভিক তাকে  দারুচিনি দ্বীপের শালীনতার থেকে একদিন বঞ্চিত করে দেবে। তার চোখের জলের প্রতি ফোটায় যেন প্রতারণায় পাওয়া গভীর বিষাদ লুকিয়ে আছে।

তুমিও বুঝলে না বনলতা ? আজ আমি যে যক্ষের বদলে দাড়িয়ে, শাস্তি কেবল একটা জন্মের।জানো আজ অলকা-পুরিতে যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে ফিরে গিয়েছে। ওদের দূরত্ব আর অভিশাপ নয়...
আর সেই ছেলেটা ,যাকে ফ্র্যান্সেসচিয়ালো বলেছিলাম সে আজ ঝুলছে ওর মায়েরই মত। গাছের গায়ে সে আঁচর কেটে লিখে গিয়েছে, ওই দেখ,
                                      “হেমন্ত আবার আসবে..."
                   












  




No comments:

Post a Comment