অপদার্থ

মেসে থাকতে একটা দাদার মুখে সর্বদা শুনতাম,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না...”।তাকে সেরকম কেউ পাত্তা দিত না,সারাদিন নিজের মতোই দিন কাটাত সে।তার শুনেছিলাম নার্ভের রোগ আছে কিছু, তবে আমি তাকে কখনও সেরকম ভুগতে দেখিনি। চোখে চশমা, কিছুটা আঁতেলগ্রস্থ চেহারা আর আস্থমার রোগে কাবু কিন্তু দিনে দুবার সুখটান চাই – চাই, এরকম ভাবেই চিনতাম তাকে। তবে তার বিশেষ গুণ ছিল,তার জ্ঞান,তাকে দেখে ভারী লোভ হত তার এই গুণটা পাওয়ার। মধ্যরাতে মাঝে সাঝে তর্কাতর্কিও হত ভিন্ন মতামত পেষ করার দায়ে আবার মাঝে সাঝে এক গাল হাঁসিতে শেষ হত দিনটা।
আমাদের মেস ছেড়ে তাকে একদিন চলে যেতে হয়, কারন তার বাবার হুকুম।তার বাবা পরিষ্কার জানিয়েছে তাকে যে যদি চাকরির পরীক্ষার জন্য খাটতেই হয়,তালে বাড়িতে থেকেই খাটো, বেকার মেসে থেকে টাকা ধ্বংস করে কাজ নেই।
সে চলে যায় একদিন খুব ভোরে মেস ছেড়ে, আবার সেই নিজের বাড়িতে যেটিকে সে জেলখানা বলেই মানত, আর বাবাকে ভাবতো সেখানকার ওয়ার্ডেন্ট। আসলে তার বাবারও দশ ছিল না। ছেলে শরীরে আর বয়সে বড় হলেও তার এখনও মস্তিষ্কের বৃদ্ধি খুব একটা ঘটেনি বলে সে মনে করে। তাই দিনে দশবার টেলিফোন খোঁজ নিত তার।
সেদিন মধ্যরাতে যখন সে বলেছিল আমায় ,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না…” সেদিন খটকা লেগেছিল একটা।
ছেলেটির প্রতি কথার মধ্যে একটা বিদ্রোহের ইঙ্গিত থাকত,আর সেটার স্লোগান ছিল তার মনের কোন এক কোণে সহস্র দেসিবেলে চিৎকার করতে থাকা, “একবার বুঝতে চাইলে না বাবা…”

কেটে গিয়েছে আজ বেশ কিছু মাস তার মেস ছেড়ে চলে যাওয়ার। তিনতলার চিলেকোঠার ঘরে থাকত সে, একাই থাকত। মাঝে সাঝে নিচে শুতে আসতে বললে ,বলতো, “ভাই,আমার ঠিক অন্য বিছানায় ঘুম আসবেনা”।।
পরশুদিন ভোর বেলা মেসের ছাঁদে বসে আছি, আকাশে মেঘ ছেয়ে গিয়েছে চারিদিকে যেন দিকে দিকে সহস্র প্রিয়ার অপেক্ষা মেটাতে তারা আজ প্রখর। একটা মৃদু বাতাস বয়ে চলেছে চারিপাশে,থিক যেন বহু যুগ পর কোন মৃত রাজার কাল-কোঠরি থেকে মুক্ত আজ সহস্র আত্মা।তারা যেন এই আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে নতুন রাগের আবিষ্কার ঘটাচ্ছে আর সেই রাগ ভেসে আসছে দূর থেকে, হয়তো কোন সমুদ্র সৈকত থেকে। যেখানে এক যোদ্ধা মৃত্যু কাছে পরাজিত হওয়ার আগের মুহূর্তে বেঁচে থাকা পালন করছেন সমুদ্র গর্জনে।
কিন্তু এসবের মধ্যে সেই আমার মেসের হারিয়ে যাওয়া দাদা কোথায়? তাই তো?

সে আছে তো, ওই যে আজ এক মৃত রাজার খাঁচা থেকে উরে গিয়েছে কিছু আত্মা, পাখির মতো ডানা মেলে।তার মধ্যেই ভালো করে খুঁজলে পাওয়া যাবে তাকে। তাকে বেধে রাখতে অক্ষম আমাদের সমাজ যে আবার এখন ব্যস্ত কিছু নতুন আত্মার ওপর কব্জা করাতে। যে এখন উন্মাদ কিছু হাজার মানুষের আত্মাকে কাল-কোঠরিতে পিষে মাড়তে।
কিছুদিন আগে বাড়ি ফিরেছিলাম, তখনই বিকেলে আড্ডা মাড়তে গিয়ে শুনি দাদা আর নেই। এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা যে সে সকালে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে কলেজের মাঠের শেষ প্রান্তে, যেখানে কেবল দুটি গাছ মাথা তুলে দাড়িয়ে, তার তলায় বসেছিল এসে।
আর সেখানেই বসে সে বিষপান করে।
সেদিন ছাঁদে দাড়িয়ে পাশের বাড়ির ছাঁদের দিকে যখন তাকালাম, ঠিক যেন আমার সেই দাদা বসে গাছের তলায়, হাতে একটা শিশি , আর চশমা চুইয়ে পড়ছে জল,তবু মুখে হাসি।
তার দেহ পরে লুটোচ্ছে মাটিতে, গাছের তলায় আর মুখ দিয়ে অহরহ গ্যাঁজলা উঠছে।তার বিদ্রোহ সেদিনই শেষ, তবে...
লোকে তবুও বলবে বিদ্রোহীরা আত্মহত্যা করে না, তারা লড়ে যায়।
কিন্তু তখন যদি আমি বলি,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না...”



No comments:

Post a Comment