আমার গল্প

জুলাই মাসের ঠিক শেষ চলছিল, আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে মাটিতে প্রতি মুহূর্তে। ছাতা হাতে সাইকেল চালিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম কেমিস্ট্রি স্যারের বাড়ি। বৃষ্টির ছাটে জামা কাপড় প্রায় ভিজে চুপচুপে, রক্ষে কেবল মাথায় জল লাগেনি। পচা ড্রেনের জল রাস্তায় উঠে চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে আর সেই বিরক্তির সাথে তাল মিলিয়ে কোথাও যেন কেঁদেই চলেছে এক পরিবার।কিছুটা এগিয়েই চোখে পড়ল একটা বাড়ির উঠনে ত্রিপল টাঙ্গান আর মেজেতে শুয়ে রয়েছে বছর ২৫য়ের একটা ফুটফুটে ছেলে। ভাল করে দেখলাম তাকে ছাতার আড়াল থেকে, নিঃশ্বাস পড়ছে না আর।পাশে একটা কাঠের বাক্স রাখা যেটার মাপ ছেলেটার শরীরের মাপেই বানানো বলে মনে হল।
একটু ধরেছে বৃষ্টিটা তখন,ছাতা বন্ধ করলাম সাইকেল থামিয়ে।পাশে কিছু লোক বলাবলি করছে শুনলাম ওই ছেলেটিকে নিয়ে। শুনলাম গলায় ফাঁস লাগিয়ে নিজেকেই হত্যা করেছে ছেলেটি।
কিন্তু কেন?

সেদিন আর পড়তে যাওয়া হল না, জানিনা কেন আমি বেশ জড়িয়ে পড়েছিলাম নিজের ভাবনা চিন্তায়। ভাবনা –চিন্তা বলতে কেবল দুটো প্রশ্ন…
কেন এ আত্ম্যহত্যা?

আর আত্ম্যহত্যায় কি হত্যাকারী শাস্তি পায়না?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেতে বেশি দেরি না হলেও, শেষের প্রশ্নটি বোধ্যয় তুলে রাখা ছিল আজকের জন্য। আত্ম্যহত্যার কারন হিসেবে পাওয়া গেল এমন কিছু যা সারাধরনত আত্ম্যহত্যার কারন হয়ে উঠতেই পারেনা।কিন্তু, এ পৃথিবী যে চিরকাল বিচ্ছেদ গাথা লিখতেই জীবিত, এখানে জীবন বলতে যে শুধু কিছু নিয়ম কানুন আঁকড়ে বেঁচে থাকা নয় সেই চিন্তা ধারার থেকে মানুষের বিচ্ছেদ অনেক আগেই ঘটে গিয়েছিল।তবু যারা এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারেনি, তাদের সহ্য করতে হয়েছে পৃথিবীর থেকে বিচ্ছেদ। ঠিক এরকমই ছিল এই আত্ম্যহত্যার কারণটা...
ছেলেটি থাকতে পারেনি একটা বন্ধ ঘরে, যেখানে আলো ঢোকে না দুপুর বারোটায়ও, সে নিরুপায়। সে কেবল শ্যাওলা পড়া দেওয়ালে যীশুর ছবির দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকে, যেন কোন নারী তার চোখের কাজল মুছছে আয়না দেখে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল ছেলেটি স্কুলে পরতেই।হয়তো তাকে সহ্য করতে হয়েছিল কোন অত্যাচারী মাস্টারের ছড়ির ঘা, বা কোন এক দূর দেশের পরীর প্রতারণা।
আচ্ছা সব সমায় আমরা সব কিছু এতো কঠিন করে ভাবি কেন?
এরকম কি হতে পারেনি যে চোট পেয়ে সে ভারসাম্য হারিয়েছিল ?
কিন্তু এরকমও তো হতে পারে যে তার মানসিক ভারসাম্য হারানোর কারণও আত্ম্যহত্যা ছিল?
হয়তো কোন এক অজানা কারণে সে আত্ম্যহত্যা করতে গিয়েই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আজ সে সফল...
পেড়েছে তার ষড়যন্ত্রকে কেউ আটকাতে?...

দ্বিতীয় প্রশ্নটা বিশেষ মনে ছিল না এতদিন , তবে আজ মনে করতে হল। আসলে এটা মনে পড়ারই ছিল একদিন।

আমার শেষ চিঠিটা আমার মা পড়েছে?
বড্ড কাঁদে মা...
চিঠি লিখেছি তো জবাব পাব বলেই, বোকা মহিলাটি এটাও বুঝল না।।সেদিনের সেই প্রশ্নের জবাব আজ নিজেই দিচ্ছি আমি...
আমার প্রয়োজন নেই সেই প্রশ্নের উত্তরের তবে দরকার আছে আগামীদের।
হ্যাঁ আমি নিজের হত্যা করেছি। জানো ছোটবেলা থেকে দেখেছি নিজের গায়ে নিজে মাড়লে লাগেনা...
সত্যি লাগেনা?
নাকি ওগুলো কেবল অভিনয়? কখনও সজোরে একটা ছুরির আঘাতে নিজের হাতের শীরা কেটে রক্ত বেড়তে দেখলে বোধহয় বোঝা যাবে কেবল সেটা।
রক্তের গন্ধ অনেকটা বারুদের মতো, খনিকে ধ্বংস করে দিতে পারে একটা পরিবারকে, উজ্রে দিতে পারে সেই নিয়ম কানুন বাঁধা জীবনকে। আত্ম্যহত্যায় হত্যাকারীকে সব থেকে নির্মম শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করতে হয়। তাকে বসে নিজেরই মৃত্যু-খেলা দেখতে হয় আর দেখতে হয় তার মা কে। তার মা ভেঙ্গে পড়েছে মাটিতে,ঠিক যেন শ্রাবণের সূর্যাস্তে ঝমঝমে বৃষ্টির মতো। কিন্তু মা গো...
দোষ তো আমার ছিল না।
দোষ ছিল জীবনের, দোষ ছিল গায়ের রক্তে, যে রক্ত আমি রেখে এসেছি আমার ঘরের মেজেতে...
দোষ ছিল আমার কেবল নিচু জাতিতে জন্মগ্রহণ করা, তাই শুধরে নেওয়ার চেষ্টায় আজ যেতেই হল। বাড়ির গেট দিয়ে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমার দেহ, পাশে দাড়িয়ে এক অচেনা লোক বলে উঠল, “ তোমার শেষ যাত্রা, আবার প্রথম থেকে শুরু...”
তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছেনা, তাকে কেউ চেনেনা...
আমি চিনি।।
জিজ্ঞেস করলাম,” তুমি সেই ছেলেটা না??”
সে কেবল হাসল।

আসলে বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা , মুক্তি... এসব কিছুর ঊর্ধ্বে শুধু একটা কথা বলতে পারি...
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য কেবল একটা ছোট্ট আলোর উৎসর। মৃত্যু মানে একটা অন্ধকার ঘরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকা আমি।


অপদার্থ

মেসে থাকতে একটা দাদার মুখে সর্বদা শুনতাম,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না...”।তাকে সেরকম কেউ পাত্তা দিত না,সারাদিন নিজের মতোই দিন কাটাত সে।তার শুনেছিলাম নার্ভের রোগ আছে কিছু, তবে আমি তাকে কখনও সেরকম ভুগতে দেখিনি। চোখে চশমা, কিছুটা আঁতেলগ্রস্থ চেহারা আর আস্থমার রোগে কাবু কিন্তু দিনে দুবার সুখটান চাই – চাই, এরকম ভাবেই চিনতাম তাকে। তবে তার বিশেষ গুণ ছিল,তার জ্ঞান,তাকে দেখে ভারী লোভ হত তার এই গুণটা পাওয়ার। মধ্যরাতে মাঝে সাঝে তর্কাতর্কিও হত ভিন্ন মতামত পেষ করার দায়ে আবার মাঝে সাঝে এক গাল হাঁসিতে শেষ হত দিনটা।
আমাদের মেস ছেড়ে তাকে একদিন চলে যেতে হয়, কারন তার বাবার হুকুম।তার বাবা পরিষ্কার জানিয়েছে তাকে যে যদি চাকরির পরীক্ষার জন্য খাটতেই হয়,তালে বাড়িতে থেকেই খাটো, বেকার মেসে থেকে টাকা ধ্বংস করে কাজ নেই।
সে চলে যায় একদিন খুব ভোরে মেস ছেড়ে, আবার সেই নিজের বাড়িতে যেটিকে সে জেলখানা বলেই মানত, আর বাবাকে ভাবতো সেখানকার ওয়ার্ডেন্ট। আসলে তার বাবারও দশ ছিল না। ছেলে শরীরে আর বয়সে বড় হলেও তার এখনও মস্তিষ্কের বৃদ্ধি খুব একটা ঘটেনি বলে সে মনে করে। তাই দিনে দশবার টেলিফোন খোঁজ নিত তার।
সেদিন মধ্যরাতে যখন সে বলেছিল আমায় ,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না…” সেদিন খটকা লেগেছিল একটা।
ছেলেটির প্রতি কথার মধ্যে একটা বিদ্রোহের ইঙ্গিত থাকত,আর সেটার স্লোগান ছিল তার মনের কোন এক কোণে সহস্র দেসিবেলে চিৎকার করতে থাকা, “একবার বুঝতে চাইলে না বাবা…”

কেটে গিয়েছে আজ বেশ কিছু মাস তার মেস ছেড়ে চলে যাওয়ার। তিনতলার চিলেকোঠার ঘরে থাকত সে, একাই থাকত। মাঝে সাঝে নিচে শুতে আসতে বললে ,বলতো, “ভাই,আমার ঠিক অন্য বিছানায় ঘুম আসবেনা”।।
পরশুদিন ভোর বেলা মেসের ছাঁদে বসে আছি, আকাশে মেঘ ছেয়ে গিয়েছে চারিদিকে যেন দিকে দিকে সহস্র প্রিয়ার অপেক্ষা মেটাতে তারা আজ প্রখর। একটা মৃদু বাতাস বয়ে চলেছে চারিপাশে,থিক যেন বহু যুগ পর কোন মৃত রাজার কাল-কোঠরি থেকে মুক্ত আজ সহস্র আত্মা।তারা যেন এই আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে নতুন রাগের আবিষ্কার ঘটাচ্ছে আর সেই রাগ ভেসে আসছে দূর থেকে, হয়তো কোন সমুদ্র সৈকত থেকে। যেখানে এক যোদ্ধা মৃত্যু কাছে পরাজিত হওয়ার আগের মুহূর্তে বেঁচে থাকা পালন করছেন সমুদ্র গর্জনে।
কিন্তু এসবের মধ্যে সেই আমার মেসের হারিয়ে যাওয়া দাদা কোথায়? তাই তো?

সে আছে তো, ওই যে আজ এক মৃত রাজার খাঁচা থেকে উরে গিয়েছে কিছু আত্মা, পাখির মতো ডানা মেলে।তার মধ্যেই ভালো করে খুঁজলে পাওয়া যাবে তাকে। তাকে বেধে রাখতে অক্ষম আমাদের সমাজ যে আবার এখন ব্যস্ত কিছু নতুন আত্মার ওপর কব্জা করাতে। যে এখন উন্মাদ কিছু হাজার মানুষের আত্মাকে কাল-কোঠরিতে পিষে মাড়তে।
কিছুদিন আগে বাড়ি ফিরেছিলাম, তখনই বিকেলে আড্ডা মাড়তে গিয়ে শুনি দাদা আর নেই। এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা যে সে সকালে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে কলেজের মাঠের শেষ প্রান্তে, যেখানে কেবল দুটি গাছ মাথা তুলে দাড়িয়ে, তার তলায় বসেছিল এসে।
আর সেখানেই বসে সে বিষপান করে।
সেদিন ছাঁদে দাড়িয়ে পাশের বাড়ির ছাঁদের দিকে যখন তাকালাম, ঠিক যেন আমার সেই দাদা বসে গাছের তলায়, হাতে একটা শিশি , আর চশমা চুইয়ে পড়ছে জল,তবু মুখে হাসি।
তার দেহ পরে লুটোচ্ছে মাটিতে, গাছের তলায় আর মুখ দিয়ে অহরহ গ্যাঁজলা উঠছে।তার বিদ্রোহ সেদিনই শেষ, তবে...
লোকে তবুও বলবে বিদ্রোহীরা আত্মহত্যা করে না, তারা লড়ে যায়।
কিন্তু তখন যদি আমি বলি,” মানুষ বেঁচে থাকতে সুখী হয় না...”



আশ্লেষা




বত্রিশ বছর পর,
বইয়ের টেবিলে পুনরায় মোমবাতি গুনব,
গুনবো শত রাত কাটানো অন্ধকার চিত্ত,
গুনবো শত নারী হত্যাকাণ্ড মোমবাতির আলোতে,

 আবার বত্রিশ বছর একদিন,
তোমার মায়া আজ বেসিনে ধুয়েছি,
প্রত্যেক মুহূর্তে তোমা হতে বহু দূরে শরে চলেছি,
জানালার পাশে ঝুলছে নাইলন যে দড়ি,
সেই ভালোবাসার নাইলন দড়ি সর্পগুণে গুনিত,
আজ কত প্রাণ শান্তি পাবে তোমার পশ্চাতে,
হত্যা সেদিন করিনি আমি...
করেছে আমার পাষাণ...
আমি নির্দোষ ,
আজও স্বপ্ন তোমার মৃত্যু-জোছনায় মেতে,
কলমের শেষ আঁচর তাই রক্ত মাংস শরীরে,
রক্তে ভেসেছে সেই বিষ টান...
কালো-রক্তে সারা ঘর কলঙ্কিত হয়েছে,

মোমবাতি নিবিয়েছি আবার কাতর রক্ত-গর্ভে,
মরীচিকাময় মৃত্যু-খেলায় শত মোমবাতির আলো মিথ্যে,
মিথ্যে ঊর্ধ্বাঙ্গে চলাচল,
হত্যাকারী-পাষাণ আমাকে মেরেছে প্রতিনিয়ত,
হস্তরেখায় হত্যা-তোমার দগদগে রক্ত মাখা,

মৃত্যু তুমি অগস্ত্যযাত্রা,তুমি আমার আশ্লেষা।।

হেমন্ত



খাতা খুলতেই প্রথমে চোখে পড়লো রয় হ্যচটনের লেখা চারটি লাইন...
মৃত্যু আমার কাছে খুব স্বাভাবিক আর,
একদিন আমায় কবর দেওয়া হবে কোন এক পাথরের নিচে,
আর তখন সেটা অস্বাভাবিক কিছু হবেনা...
জীবনের মতই স্বাভাবিক হবে মৃত্যু...

খাতাটি বন্ধ করে তাকালাম আয়নার দিকে, গালের দারিগুলো বেশ বড় হয়েছে, ওজনটাও বেড়েছে বলেই মনে হল। চুলে পাক ধরেছে আর গায়ের চামড়াও কুঁচকে গিয়েছে।আসলে অনেকদিন সূর্যের আলোর সাথে সম্পর্ক ছিল না কোন। কেবল চার দেওয়াল আর তাতে পাথরের আঁচর।ভেন্টিলেটরের মধ্যে দিয়ে দেখতে পেতাম কেবল একটা গাছ, আর হেমন্তের ঝরা পাতার আওয়াজ ধেয়ে আসত আমার দিকে।আর মাঝে সাঝে আসত গাছের গায়ে পাথরের আঁচরের শব্দ।

কিছু বছর আগে বেশ চলছিল জীবনটা, পত্রিকায় লিখে দিব্বি পেট চলে যাচ্ছিল। বাড়িতে লোক বলতে স্ত্রী আর মেয়ে। মেয়েটির বয়েস তখন ৫ বছর।ফুটফুটে পুতুলের মতো সারাদিন ঘুরে বেড়াত সারা বাড়ি।আর স্ত্রীয়ের সাথে সপ্তাহে একবার বচসা লেগেই থাকত। আমার রাত পর্যন্ত কাজ থাকত,তাদের সারাদিন একাই থাকতে হত।তবে সপ্তাহের শেষে ঘুরতে বেড়ানোর পালা আসত,তখন বেশ সব রাগ-ঝাপ ধুয়ে মুছে যেত,ঠিক যেন স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোকে চুম্বন করেছে বর্ষার আদ্রতা।

সবে গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে , হেমন্তের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী । তুচ্ছ খাদ্য- যন্ত্র গুলো সেদিন একে-একে পরে মিশে যাচ্ছিল মাটির সাথে। যেন আত্মহত্যা আগে শেষ কাছের মানুষটিকেও দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্র। হেমন্তের ঝরা পাতা যেন মানব সমাজেও অভিশাপ বয়ে নিয়ে এলো আর নিমেষে যক্ষের প্রিয়ার খবর এনে আছড়ে ফেলল আমার ঘরের উঠনে।
হেমন্ত, এ তোমার কাজ,মেঘ দিব্বি অলকাপুরির দিকে ছুটে চলেছিল।

 রাতে খবর এলো ,আর চাকরি নেই
কাল রাত্রে কোন এক অজানা দুর্ঘটনায় পত্রিকার প্রিন্টিং কারখানা ও অফিস দুটোই পুড়ে ছাই।পরদিন সকালে ঘটনা স্থলে গিয়ে দেখলাম হেমন্তের আত্মত্যাগের গন্ধে মেতে উঠেছে চারিপাশ। আবার সেই খাদ্য-যন্ত্রেরই বলিদান এখানেও। আর
আসলে বলিদান কথাটা এখানে সামাজিক, যদি সত্যি দেখতে হয় চোখ ফেরাও একবার হেমন্তের নেরা গাছের তলায় বসে থাকা ওই মায়ের দিকে যে নিজের বাচ্চাকে আঁচলের নিচে স্তন্যপান করাচ্ছিল।মাথার উপর তার ছায়া নেই, তাকে প্রতিপদে হতাশার সাথে হাসি মুখে চলতে হচ্ছিল , “কেমন আছ?” প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে।
তার উত্তর সে দিয়েছিল...
কিছুদিন বাধে ওই গাছেই ঝুলছিল তার মৃতদেহ আর নিচে বসেছিল ছোট্ট বাচ্চাটির রূপে ফ্র্যান্সেসচিয়ালো যার চোখে মুখে ভেসে আসে কেবল একটাই কথা,
                                                               “আমার সম্মান বিক্রয় হয় না
পরের দিন ছেলেটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি আর পাওয়া যায়নি তার মধ্যের ফ্র্যান্সেসচিয়ালোকে।

আমি ওই মহিলাটির মত ভুল করিনি।সেদিন রাতেই শেষ বার কথা হয়েছিল স্ত্রীয়ের সাথে, তারপর ওদের ঘুম পারিয়ে দিয়েছিলাম। কি করে সহ্য করবে ওরা এ কঠিন পৃথিবীকে?
বরং ওদের নিদ্রা-ছন্ন করে রাখলেই ওদের শান্তি।
ওরা ঘুমচ্ছে।।
ঘুম পারিয়েছি আমি।। না আমি স্বার্থপর না...
কিন্তু আমাকে তো ওই নামেই চেনে সবাই।আমায় পাষাণ বলে ডাকে সবাই...
সবাই??

আমি ওদের খুন করিনি, ওদের শান্তি দিয়েছি। আবার বলছি, ওরা পারত না সহ্য করতে অনাহার, ওরা পারত না সহ্য করতে ভিটে-বাড়িহীন জীবন।আমি ওদের হয়ে নিজেই সহ্য করছি যে,
আমি তো কোথাও যাইনি।।

পুলিশেও নিজেই ধরা দিয়েছিলাম,আসলে অনাহারে প্রায় অর্ধ-মৃত হয়ে গেছিলাম।তারপর আজ কুরিবছর পর আবার সমাজের সম্মুখীন।
আমার বয়স এখন ৫৩, দীর্ঘ ২০ বছর পর আজ কেবল এটা মনে হল আরও কিছুদিন যদি ওই ঘরেই থাকা যেত। বেশ তো ছিলাম ওখানে আমরা তিন জন।
হ্যাঁ তিন জনই...
ওরা আসত মাঝে মাঝেই,
আমার মেয়ে, মিনি, মাথা রেখে ঘুমত আমার কোলে।কেবল তার একটা প্রশ্নেরই কখনও উত্তর দিতে পারিনি...
বাপি আমায় মারলে কেন?...”

আর আমার বনলতা...
সে আর কথা বলেনি,কেবল এক ভাবে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। তাকে দেখে মনে হত সে ভাবেনি সেই হাল ভাঙা নাভিক তাকে  দারুচিনি দ্বীপের শালীনতার থেকে একদিন বঞ্চিত করে দেবে। তার চোখের জলের প্রতি ফোটায় যেন প্রতারণায় পাওয়া গভীর বিষাদ লুকিয়ে আছে।

তুমিও বুঝলে না বনলতা ? আজ আমি যে যক্ষের বদলে দাড়িয়ে, শাস্তি কেবল একটা জন্মের।জানো আজ অলকা-পুরিতে যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে ফিরে গিয়েছে। ওদের দূরত্ব আর অভিশাপ নয়...
আর সেই ছেলেটা ,যাকে ফ্র্যান্সেসচিয়ালো বলেছিলাম সে আজ ঝুলছে ওর মায়েরই মত। গাছের গায়ে সে আঁচর কেটে লিখে গিয়েছে, ওই দেখ,
                                      “হেমন্ত আবার আসবে..."
                   












  




অমূলপ্রত্যক্ষ

"আম্মা,আমি আল্লাহর নিকট আজ নিজেকে দান করলাম..."
লেখা চিঠিতে।
মা নেই ছেলেটির,জন্ম তার অভিশাপ,
তাহলে কে তার মা?
সে লিখেছে নিজের জন্মভূমির কাছে,
মনে রেখ ,
যে জন্মভূমি জেহাদ মানে প্রাণ বোঝে,
সে মৃত্যুমঞ্চও জেহাদির ভালবাসা পায়।
জন্মের পশ্চাত সে কখনও বাবাকে দেখেনি,
তবে সে ভয়ানক বকুনি শুনেছে বেয়নেটের নলের।
তাকে কেউ কাঁদতে শেখায়নি,
সে কেঁদেছে বোমাবাজির হাহাকারে।
আজ সেও নেই...
খুঁজে দেখ সে লুকিয়ে কোনো মিথ্যে জেহাদের কবরে।।

উড়ে যাওয়া কিছু চিঠির মাঝে হাতে লেগে পরে গেল একটা,
সে লিখছে,
" ঈশ্বর, তোমার ধর্ম ব্যর্থ...
ব্যর্থ তুমি পৃথিবীর উপদ্বীপে"
সে যে এক সাধারণ নারী, তার দিন কাটে হারেমের তোসামদিতে,
তার দেহ আজ পুঁতে রেখেছে কোন দুষ্কৃতি ইরাকের সমতলে
সে লিখেছে তার ভালবাসার কাছে, যার জন্য সে বসে থাকত নদীর কুয়াশায়,
ছেলেটি হয়তো কখনও ফেরেনি,
হয়তো ফিরেছে বার বার যুদ্ধের সংবাদ, নয়তো রয়ে গিয়েছে চিরকাল একটা গাছ,
যাকে সে ভালবাসার নামে ডাকত

ঘরে খুব হাওয়া, এক-দু ফোঁটা বৃষ্টির জলও এসে পরছে গায়ে,
এক কোণে পরে থাকা একটা চিঠি হঠাৎ হাতের সামনে এসে পড়লো,
লেখা কেবল ,"ইতি স্বপ্ন..."
ছেলেটি তাহলে নেই হয়তো আজ আর,
সমাজ তাকে দিব্যি হজম করে নিয়েছে,
আর হজম করে নিয়েছে মানুষের,"লোকে কি বলবে?..."
হজম ছেলেটাও করেছে ,
হজম করেছে প্রতিপদে ধাক্কা, আর সামাজিক প্রতারণা,
জাত-পাত, ধর্ম কিছু ছাড়েনি তাকে,
হত্যা করেছে তাকে নিষ্ঠুর ভালবাসা,
সবার খাবারের থালায় সমান ভাবে রয়ে গেছিল সে,
তার মৃত্যুর প্রতিবাদও কেবল এক সামাজিক রাজনীতি৷

বাইরের বৃষ্টিটা বেড়েছে, ঘরের টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আলোও নিভে গেল,
তারপর চোখের সামনে যেন মিছিলের পর মিছিল,
নাহ, ভুল করছি,
ওই তো হালিমের ভিতর গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে একটি মেয়ে,
ওই তো মন্দিরের বাইরে খিদের জ্বালায় বিষপান করছে এক গর্ভবতী৷
আলো ফিরতেই চিঠিগুলো উধাও,
আর উধাও তারা...।।