পুতুলওয়ালা

ফেরার পথে সে পকেট হাতড়াছে একটা বিড়ির খোঁজে। অনেক কসরতের পর খুঁজেও পেল তার দিনের শেষ বিড়িটা। বিড়িটা জ্বালিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার মাথায় ঘুরচ্ছিল নানান চিন্তা ভাবনা। পুতুলের দোকানে আজ বিক্রি হয়নি সারাদিন। দোকান বলতে সেই ফুটপাথের ধারে ট্রিপলের ওপর রাখা সরঞ্জাম । ওই দিয়েই তার পরিবার চলছে আজ ১৫ বছর। চলছে বলতে গরুর গাড়ি যেমন চলে গ্রামের কাঁচা এবড়োখেবড়ো রাস্তায়। রান্নাঘরে ভাতের হাড়ি চরে দিনে একবার। মেয়ে দুটো বড় হয়েছে,বিবাহের যোগ্য আজ তারা। সর্বদা মাথায় এই চিন্তা। ছেলেটারও তো সৎ গতি হলো না কোনও। জীবনটা তার সাথে সেই বাল্যকাল থেকে প্রতারণা করেছে। তার স্বর্গত বাবা মা তার জন্মের পর থেকেই আলাদা। তার বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার মা তাকে ছেড়ে পরপুরুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। মায়ের মমতা বা বাবার শাসন কিছু মেলেনি তার।সেদিন হঠাৎ অন্ধকার রাস্তার মাঝে একা হাঁটতে হাঁটতে তার মাথায় জটলা পাকাচ্ছিল সব।হঠাৎ সে বসে পরল একটি গাছের তলায়।তখন রাত বেশ গভীর, কিন্তু সে চলার জোর পেল না।ধপ! করে বসে সে আপন মনে লড়াই করতে লাগল নিজের জটলা পাকানো চিন্তাভাবনা গুলোর সাথে। রোজ সে লড়ে যায় তার জীবনের পেরিয়ে আসা কাল আর আজকের সাথে। তবে আজ ফাঁকা পকেটটা বোধহয় তাকে কমজোর করে তুলেছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে। বসে থাকতে থাকতে সে আবছা আচ্ছন্নতার মাঝে দেখতে পেল তার ছেলে তার মতো পুতুল বিক্রি করছে হাট বাজারে। মন বলে উঠল কত ভেবে সে তার ছেলের নাম রেখেছিল মানিক, ভেবেছিল ছেলেকে অনেক বড়ো মানুষ বানাবে।কিন্তু পেটের খিদে যে সবসময় তার এই চিন্তা গুলোকে বিদ্রোহ জানিয়েছে।
                 রাত তখন বেশ গভীর,সে উঠে বাড়ির পথে চলার সিদ্ধান্ত নিল।কিছুটা পথ তখন সে এগিয়েছে,হঠাৎ পিছন থেকে একটি মাল ভরতি গাড়ি সজোরে তাকে আঘাত করল। সে মাটিতে লুটিয়ে পরল।তার আশপাশটা তার রক্তের লাল রঙের চাদরে গা ঢাকা দিল। তবে রক্তাক্ত দেহটিতে তখনও প্রান ছিল খনিকের জন্য। চোখ দিয়ে দুফোটা জল তার রক্তাক্ত দেহে মিশে গেল।হ্যাঁ সে হেরে গেল আজ তার নিজের সব স্বপ্নের কাছে,তার পরিবারের সব স্বপ্নগুলোর কাছে।তারপর তার শরীর থেকে তার এই জীবনের সব চিন্তা ভাবনা, স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষাগুলো মুক্তি পেল। সেই ছোট্ট থেকে কাজ করে খাওয়া হাত দুটো অদ্ভুত শান্ত। এবার তার অবসর জীবনের পালা। অনেকে বলবে,"গরিবের আবার অবসর জীবন!!!!"... তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন,মৃত্যুটা অবসর নয় কি?... কত জ্বালা , যন্ত্রণা থেকে তার মন আজ মুক্তি পেল। তবে ফেলে গেল তার নিজের কিছু মানুষকে যারা হয়তো তার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকত রোজ।
                    পুতুলওয়ালার দোকানের জায়গাটা বেশ কদিন ফাঁকা থাকল, কিন্তু তার পর সেখানে আবার শুনতে পাওয়া গেল ,
          "দাদা পুতুল নেবেন? কৃষ্ণনগরের ভালো মাটির পুতুল..."
গলাটা ঠিক তার বাবার মতো। সে এখন তার বাবার গরিবিয়ানা আর দোকানের উত্তরাধিকারী। রাতে ঘরে ফেরার সময় সে ও আজ নানা চিন্তাভাবনায় মগ্ন হয়ে থাকে।
অনেক দিন আগে কোথায় যেন একটা পড়েছিলাম," সন্তানের নামকরণকালে পিতামাতার মূঢ়তায় বিধাতাপুরুষ অন্তরিক্ষে থাকিয়া অধিকাংশ সময় শুধু হাস্য করিয়াই ক্ষান্ত হন না, তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাই তাহাদের সমস্ত জীবনটা তাহাদের নিজের নামগুলাকেই যেন আমরণ ভ্যাঙচাইয়া চলিতে থাকে।"...
আজ হয়তো তার বাবার দেওয়া নামটাও তাকে অবসর সময়গুলিতে ভ্যাঙচায়।।

2 comments:

  1. Its sad to see how generations after generations are still fighting against proverty .
    Every story does not have happy endings.

    ReplyDelete
  2. Its sad to see how generations after generations are still fighting against proverty .
    Every story does not have happy endings.

    ReplyDelete