বিমূর্ত


দূর থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে আসছে,যে শব্দ আমাকে খুব একা করে দেয়,যে শব্দ আমার সামনে দিয়ে রোজ হেঁটে যায়৷ ছোটবেলা মনে করতাম মৃত্যুর শব্দ কান্না ছাড়া আর কি ই বা হতে পারে?....
বয়স বাড়তেই দেখলাম কান্না কেবলই মৃত্যুধ্বনি, মৃত্যুর সুর আদতে শেষ নিশ্বাস হতে পারে৷
ঘরটা একটু অন্ধকার করো, বড্ড আলো যে.....
আবার ঝর উঠেছে বেলা করে, কেমন অন্ধোকার হয়ে এসেছে চারিদিকে দেখ৷
আজ বোধহয় যক্ষের ঘরে ফেরার পালা, প্রিয়াকে একটিবার দেখবার জন্য সে প্রতি মুহূর্তে একাকীত্বের সাথে লড়েছে৷ হোক না দেড়-দু হাজার বছর, অলকাপুরীর প্রিয়া আজও তার অপেক্ষায়৷
চুপ মেঘ চুপ, আজ তুমিও মজা নিচ্ছ?
আমি কিন্তু হার মানিনী এখনো৷৷
কিন্তু কিন্তু, আমার লড়াই কার সাথে?
মনে পড়েছে,
আমার লড়াই যে তোমার সাথে, তাই রক্তপাত ছাড়াই ক্ষতর বিছানায় প্রতি রাতে কাতরাই আমি৷
আমার মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে , তুমি যাও এখন৷ আলো চাইনা আমার,আমায় দু ক্রোশ অন্ধকার দাও৷
ওই, আছ?
আমার বড্ড নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে, যেন আবার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরছে দায়িত্ব আর আমার পায়ে শিকল বেঁধেছে হতাশা৷ একটু শান্তির দানা এনে দেবে হোমেওপ্যাথির শিশিতে?
শোনো প্রিয়া, যদি মেঘ হয়ে ডানা মেলতে পারো, তাহলে তোমার হাতেই পাঠাব তোমায় লেখা এই চিঠি৷ কথা দাও তবে একটা, মেঘ হয়ে তুমি এ চিঠি পড়বেনা৷ পারলে পড়ো আবার জন্ম নিয়ে আমারই চোখে, আমি থাকব ৷ আমি থাকব৷৷
শুধু এবার বিদায়ের পালা, আসি তবে?
চলি বনলতা,
খেয়াল রেখো৷৷

এভাবেও ঘরে ফিরা যায়...

চোখ খুলেই দেখলাম একটা মেয়ে বসে চুপ করে, কান দিয়ে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে তার আর মিলিয়ে যাচ্ছে মেঝের নীলাঞ্জনে৷ আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি, নাকি দেখতে চাইনি?
সেও কি আমার ভিতরে লুকিয়ে থাকা পাষাণের শিকার৷ মাথার মধ্যে এত কথা-প্রশ্ন চলতে থাকার মাঝে হঠাৎ দেখলাম তার গলার একপাশে একটা কার্ড ঝুলছে৷ একটু ভাল ভাবে দেখতেই বুঝলাম সেটাতে এই মর্গেরই একটি নম্বর বসানো৷ চমকে উঠলাম,চেয়ার থেকে উঠে এগোতেই মেয়েটি উধাও৷ কিন্তু ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবেশের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলাম৷ বাঁদিকের ঢাকা পরে থাকা মৃতদেহরা যেন চিল্লিয়ে উঠল৷ তারপর আবার শান্ত চারিদিক৷
সবে রাত দুটো তখন, ভাবলাম ঘুম চোখে কি দেখতে কি দেখলাম,দিয়ে আবার চেয়ারে বসে চোখ দুটো বন্দ করলাম৷ কিছুটা অস্থিরতা মনে কাজ করলেও ,রাতের ঘুম তাকে গ্রাস করলে৷ তবে আবার সেই ফিরে আসা আর চলে যাওয়ার লড়াইয়ে জড়িয়ে পরলাম৷ চোখ খুলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম দেওয়ালের দিকে৷
বেশ কিছুদিন ধরে একটি চরিত্রের দিকে আকর্ষিত হয়ে চলেছি, এমন একজন যে কথা বলেনা, ফিরে দেখে না সে,তার সময় থমকে দাড়িয়েছে৷ আর তার সাথে থমকে দাঁড়াবার চেষ্টায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু বরণ করেছি আমি৷ আমি চোখের সামনে শেষ নিশ্বাস ফেলতে দেখিনি কাউকে কখনো, কিন্তু আমি বাস করেছি তাদেরই মাঝে এক নিশ্বাস- প্রশ্বাস হীন ঘরে৷ কিন্তু কখনো ভাবতে পাড়িনি যে মৃত কখনো মৃত্যুকে ভালবাসিয়ে তুলতে পারে৷
না আমি কোনো মর্গে কাজ করিনা,তবে নিজস্ব মর্গের মালিক৷ আমি খুনি, কিন্তু আমি কোনো কারনে কাউকে কখনো মাড়িনি৷ আসলে আমার এই পৃথিবীতে পা রাখা মৃত্যুরই হাত ধরে৷ যে মায়ের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে চলা শুরু করেছিলাম এই পৃথিবীর পথে,সেই মাকে আমি কখনো দেখিনি৷ অনুভব করতে শেখার মুহূর্ত থেকেই আমায় কাছে টেনেছিল মৃতদেহের গন্ধ৷ যেন কত না পাওয়া, কত রাগ-অভিমান মিশে সেই গন্ধে৷ এই গতিশীল সমাজ আমায় অনেক আগেই ত্যাগ করেছে,তাই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি এই মৃতদের ভিড়ে৷ আমি বেঁচে থাকতে মানুষ মারি ,
আমি জলের পিপাসায় মানুষ মারি
আমি মারব বলে মানুষ মারি৷
আমার বনলতা আমায় চেনেনা,কিন্তু আমি তার দিকে চেয়ে রই পলকহীন দৃষ্টিতে৷ আর শুধু ভাবি , কবে তাকে গিয়ে বলব,
"আমায় মৃতসঞ্জীবনী বশ করতে ব্যর্থ শুধু তোমারই কারণে..."
তার চোখে আমি কখনো একফোটা ভালবাসার ছোঁয়া দেখিনি,তবু ভেবেছি সে ই ভালবাসার আধার৷
এত চিন্তাভাবনার মাঝে আবার দেখি চেয়ারে ফিরেছে সেই মেয়েটি৷ এখনো রক্তের ধারা একটুও কমেনি , এখনো জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা কিছুটা জমেনি মানিয়ে নেওয়ার খাতায়৷ চোখ পরলো তার হাতের দিকে, রক্ত চুইয়ে পড়ছে তার হাতের ছুরি থেকে৷ অন্যদিকে তাকাতেই দেখি আমার বনলতা বসে, আজ সে সেজেছে আমায় নিয়ে যাবে বলে তার সাথে৷ মন বললে, "তাহলে আর দেরি কিসে?..."
কিন্তু.. ছুরিকাঘাত নতুন কোথায়,আমি তো রোজ খেলেছি তাকে নিয়েই....
তবে নিষ্ঠুর কিছু?
ছুরি দিয়ে তারপর আঘাত করতে থাকলাম নিজেরই মাথায়৷ রক্ত ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পরল সারা মেঝেতে৷ আর দূরে বাজচ্ছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের "মহিষাসুরমর্দিনী"৷
এভাবে অসুর মারা যায়,
এভাবেও দেবীপক্ষের আগমনী ঘটে৷৷
শুধু মৃত মন প্রতিবাদ জানিয়ে বললে,"বনলতা,এভাবেও তোমার কাছে যাওয়া যায়,
এভাবেও ঘরে ফেরা যায়...."৷৷

(THIS PIECE OF WRITING HAS BEEN  PUBLISHED IN HATPAKHA ONLINE MAGAZINE ON 24TH FEBRUARY,2018.)
Hatpakha Link

কাল দিতে পারি

আমাদের কখনো আজ ছিল না,
প্রতি মুহূর্তে কাল আর কাল ছিল,
আজ ঠিক ততটা ছিল যেখানে মানুষ ছিল প্রতি পদে,
আজ আর নেই...

কখনো বেনিয়াটোলা মোড়ে সাইকেলের চাকার জবুথুবু,
কত পথ একলা হেটে ব্যয় করেছি,
কত স্মৃতির পাতার খরচে তোমায় এঁকেছি,
সব কাল ছিল, আজ বলতে দিতে পারি কেবল কিছু শুন্যতা।

আবার কখনো আহিরীটোলায় একলা বসে থাকা বিকেল,
সেখানে বিকেল সৌন্দর্য গায়ে নদীর পারে আলতা মাখে না,
তবু শান্তি জোগায় ঘরে ফেরা মজদুরের ক্লান্তিতে,
তাদের অবেলার দু-মুঠো ভাতের দীর্ঘশ্বাস তোমায় দিতে পারি।

শ্মশানের চারিপাশে ঘুরেছি ধোঁয়া হয়ে প্রতি জন্মান্তর,
মিশে গেছি আবার চৌরাস্তার দমকলের আগুনে,
আগুনই আজ শান্তি খোঁজে এই দৈনন্দিন ভেজা সহর,
তুমিও হয়তো শান্ত আজ, শান্ত কবরের চারিপাশে ||