জোকার...


"সেবার শহরে দুর্গাপুজোর আগে সার্কাস এসেছিল৷ শহর বলতে নামেই শহর৷ দু চারটে পাকা সড়ক আর ল্যাম্প পোস্টের আলো৷ পুজোতে এখানে সেরকম কিছু হয়না, শুধু রামলালবাবুর বাড়ির পুজো৷ তবে সেবার সার্কাসটার জন্য পূজোর ছুটিটা বেশ অন্য আকৃতি ধারণ করেছিল৷
দা কমেডি সার্কাস"......
সে একটু থেমে..ডায়রির ভিতর থেকে একটা পেপার কাটিং বের করে আবার বললে,"হুম...এটাই ছিল নাম৷"
বাবা!! আমি জোকারের গল্প শুনবো..সার্কাসের জোকার...তুমি তো সার্কাস আর শহরেই আটকে আছো...", বাচ্চা মেয়েটি বললে...
" সেবার সার্কাসটার প্রধান আকর্ষণ ছিল সেটির জোকারের কান্ড কারখানা৷ গোটা শহরের লোক রোজ তার কান্ড কারখানা দেখে এতটা খুশি হতো যে তা বলবার জো নেই৷ নাকে বল নিয়ে নাচ করা,রিংয়ের মধ্যে উন্মাদনা,সহকর্মীদের জ্বালাতন করা,বিভিন্ন খেলা দেখানোতে সে পারদর্শী ছিল৷ সব দর্শকের খুব প্রিয় হয়ে উঠল সে৷ সারাদিন হেসে,লাফিয়ে- ঝাঁপিয়ে সে সকলে খুশির চাদরে মুড়ে রাখত৷
বাবার সেরকম ছুটি ছিল না পুজোয় সেবার৷ তাই জোকারটি কে দেখবার সৌভাগ্য ঘটল এক্কেবারে সার্কাসের অন্তিম দিনে৷ কত শুনেছি এর আগে তার কথা, মনটা কিছুতেই বাঁধ মানছিল না৷ এক কোণের সিটে বসে বসে দেখতে লাগলাম তার কান্ড কারখানা৷ চোখ দুটো যেন স্থির হয়ে রইল জোকারটির দিকে৷
তারপর হঠাৎ তার খেলা দেখানো শেষ, সে স্টেজের পিছনে চলে গেল৷ ওই কোণ থেকে স্টেজের পিছনের কিছুটা অংশ বেশ দেখা যাচ্ছিল৷ দেখলাম সে মুখ পরিষ্কার করে কি যেন বলছে একটি লোককে৷ লোকটি বোধহয় সার্কাসটির মালিক৷ দেখলাম মুখের রঙচঙের সাথে সব খুশি যেন ধুয়ে গিয়েছে তার৷ মনে হলো আচ্ছা এই কি সেই জোকার?...
জোকারটিকে নিয়ে মনে যথেষ্ট কৌতুহল জন্মেছিল৷ তাই,সার্কাস তাঁবু থেকে তার প্রস্থানের সাথে সাথে আমিও তার পিছু নিলাম৷ এগিয়ে যেতে লাগলাম আড়াল করে,যাতে সে না বোঝে যে তার পিছু নিয়েছি আমি৷ অবশেষে দেখলাম সে একটি হাসপাতালে প্রবেশ করছে৷ মন কিছুটা বাধ সাধলেও, তার পিছনে আমিও ঢুকলাম হাসপাতালে৷ দেখলাম সে ঢুকেই টাকা জমা দিচ্ছে কীসের,তারপরই,তার টাকাটা তাকে ফেরত দিয়ে দেওয়া হলো দেখলাম৷আর দেখলাম লোকটির মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়তে,যদিও কারণটা জানা হয়েছিল না তখনো৷
ঠিক মিলিয়ে উঠতে পাড়ছিলাম না স্টেজের ওপরের জোকারকে এই লোকটির সাথে৷ সে যে শুধু আনন্দ বিলিয়েছে আর এ যে কষ্ট-দুঃখের আধার৷ পাশে দিয়ে তখনই একটা ওয়ার্ডবয় যাচ্ছিল৷
ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম তাকে আর তার উত্তরে হাত পা কেঁপে গিয়েছিল৷ জোকারটি তার মেয়েকে হারিয়েছে তখন যখন সে তার মেয়ের অপারেশনের টাকার জন্য গোটা শহরবাসীদের হাসিয়ে মনোরঞ্জন করছিল৷ তার মেয়ে বেডে "বাবা,বাবা" বলে ডেকেই মারা গিয়েছে৷ আসলে ব্রেন টিউমার ছিল যে, আর টাকা জোগাড় না হলে যে অপারেশন হয়না৷
বাচ্চাটির হাসির কোনো দাম ছিল না৷ বাচ্চাটির বাবার যে কোনো স্বপ্ন থাকতে নেই৷ তারা যে গরির,তাদের জন্ম যে তীক্ষ্ণতা সেবনের জন্যই৷....."
মেয়ের চোখে জল দেখলাম৷ তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম৷ তারপর সে বললে,"ভগবান আছে বাবা?"... দিয়ে দৌড়ে নিচের ঘরে চলে গেল৷
হাতে সেই সার্কাসের কাগজটি নিয়ে ভাবলাম,"সত্যি বোধহয় ভগবান নেই... এ পৃথিবীর উল্টো পুরাণের ইতিহাস যে আজকের নয়৷ এখানে যে হাসি বিক্রি করে চোখের জল মেলে..."
আবার প্রশ্ন জাগল আজ," কী করে পেড়েছিলে সেদিন??
হে ঈশ্বর...
কী করে?

অসহিষ্ণুতা...

ভরদুপুরে রেল লাইনের ওপর পড়ে থাকা কালো ফ্রেমের একটি চশমা৷ কাঁচ দুটি ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে ঐতিহাসিক স্তব্ধতার কারণে, প্রতিবাদের ভাষা যে আজ মেরুদণ্ডহীন৷ একটু এগিয়ে,পাথরের ওপর জমাট বাধা লাল রক্তের চাক, হয়তো এ রক্ত কোনো এক প্রতিবাদির দেহের অলংকার৷ তার দেহ থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত কীসের বেশ জয়ধ্বনি বয়ে নিয়ে চলেছে৷ জয়ধ্বনি মানুষের বদলের, জয়ধ্বনি পালটা চোখ তুলে তাকানোর, জয়ধ্বনি রক্তের বিনিময় প্রাণ উৎসর্গের৷
             অত্যাচারির নাম যখন সমাজ হয়,তখন সংশোধনের পথে সব চাইতে বড়ো কাঁটা হয়ে দাড়ায় তার অধীনে থাকা মানুষ৷ বদল যে এ পৃথিবীতে কখনো রক্তের অপচয় ছাড়া সম্ভব হয়নি৷ প্রতিটি বদলের ইতিহাস যে মানুষের রক্তে লেখা,লেখা সহস্র মানবহৃদয়ের স্থগিত অশ্রুজলের মূল্যে৷
আচ্ছা সমাজ বলতে কাকে বোঝো?...
তোমার পরিবারের প্রিয়জনের শ্রাদ্ধে যারা পেট পুরে খেতে আসে নাকি যারা তোমার বিপদে তোমায় আড়চোখে অবগ্যা করে?
সমাজের গলায় যে শুধু শুনতে পাই ,"দাদা আর একটা মাছ দেবেন এখানে"  আর "এখন একটু তাড়া আছে".. এর থেকে সহজভাবে সমাজের বর্ণনা বোধহয় দেওয়া সম্ভব না৷
রক্তের চাকের দু হাত দূরেই পরে রয়েছে রক্তের মালিকের দেহ৷ উবুর হয়ে পরে রয়েছে নরদেহটি, পীঠে গুলিবিদ্ধ ক্ষত৷ পরনের সাদা ফতুয়ার রঙ বদল ঘটেছে৷ বদল ঘটেছে মৃত্যু লগ্নের৷ তার যে জন্মানোর অধিকারই ছিল না, তবু কেন এ জন্ম? এ পৃথিবী যে পরিবর্তন মানে না, মানে না সাম্যের তীক্ষ্ণতা৷ সাম্য যে লোকগাথা,সাম্য যে মিথ্যা ছলচাতুরি এ সমাজের ৷
সাম্য আজ মৃত, তার মৃতদেহের ভারে আজ ভারাক্রান্ত এই রেল লাইনে পড়ে থাকা মৃতদেহ৷
ছেলেটি যে দলিত, সাম্য তো ওদের জন্য নয়৷ সাম্য এ সমাজের অলংকার, হ্যাঁ অলংকারই বটে৷ বছরে দু একবার যেটি বের করে পড়া হয়ে৷ দলিতশ্রেনীর ক্ষমতা কোথায় এ সাম্য অলংকৃত সমাজের ভাগীদার হওয়ার, তারা যে কেবল উৎবাস্তু এ সমাজে৷ তবে সমাজের ন্যায় বড্ড কঠিন যে,তাই আজ সাম্যের হাতে খুন এ যুবক৷
তার দোষ??
হয়তো বা সে জোড় করে নিজের জায়গা বানাতে চেয়েছিল এ সমাজে৷ তার এ বেয়াদপি সমাজ কি মানতে পারে?...
ফলে শাস্তি পেতেই হলো তাকে৷
রেল লাইনে লুটিয়ে পরে থাকা গুলিবিদ্ধ যুবকটি একটা ছাত্র হতে পারে যাকে তার সমাজ মেনে নেয়নি তার জাতিগত কারনে,সে যে দলিতশ্রেণীর...নীচু জাত তার৷ সে কোনো মিছিলের মুখ হতে পারে যাকে সমাজ ছাড়েনি তার বিরুদ্ধে ঝান্ডা তোলার অপরাধে৷ সে কোনো ধর্ষিতার ভাই হতে পারত যাকে সমাজ বাঁচতে দেয়নি৷ আবার সে মৃত রহিত ভেমুলার ভাই হতে পারে যাকে হত্যা করতে সমাজের হাত কাঁপেনি একবারও৷ 
কুকুর শিয়ালে ছিঁড়ছে তার দেহটিকে, তার রক্তে পিপাসা মিটছে হিংস্রপ্রাণীদের ৷ আর তার মৃতুতে আবার স্বগর্ভে মাথা তুলে বাঁচছে এ সমাজ, আজ যে প্রতিবাদের হুংকার নেই৷
বিকেলের অস্তগামী সূর্যের আজ মাথানত এ সমাজের বর্বরতায়৷ অ্ল্প আলোতে ছেলেটির পাশে পরে থাকা ঝোলা থেকে উঁকি মাড়ছে একটি বইয়ের অংশ...
"Stride Toward Freedom"...

           
      

কাঁটাতার...

উত্তপ্ত পৃথিবীর বুকে একপ্রান্তে আজ শরৎ জাঁকিয়ে বসেছে৷ চারিদিক থেকে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ৷ বাতাসের ছন্দে উন্মাদিত কাশফুলের দল৷ দেবীর আগমন ঘটেছে এ প্রাণখন্ডে৷ নতুন জামা নতুন খুশির মাঝে কোথাও একটা লুকিয়ে চাপা রক্তাক্ত আঘাতের দল৷
এ আঘাত কাঁটাতারের বেড়ার,এ আঘাত গঙ্গা-সুবর্ণরেখার,এ আঘাত পদ্মার দুই কূলের৷ এ অকাল বোধন যে ঘরে ফেরার বেনামা উড়োচিঠি,এ শরৎ যে মিলনের আধার৷ এপার পদ্মার ঢাকের তাল ভেসে যায় ওপারে৷ তবু মানুষের আনাগোনা আজ নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ দু কূলের আন্তরিক মিলন৷ মহানগরীতে কোথাও আজ থিমের আদলে সজ্জিত বাঙালীর সবচেয়ে বিষাক্ত ক্ষত৷ ক্ষতটির বয়স বেড়েছে তবে এখনও দগদগ করে সে রাজনৈতিক আঘাতে৷
"ভাষার আদলে নতুন নামকরণ এ রাজ্যের, আজ এটা বাংলা", চায়ের দোকানে আওরাচ্ছে মানুষ এসব বুলি৷ দূরে পদ্মার চোখে জল,তার অন্য ছেলেটি যে অবহেলিত আজ৷
অবশেষে দেবীর বিদায়বেলায় আজ মূর্ছিত পদ্মার দুই সন্তান, দেবীর আগমনের অপেক্ষায় আবার কাটাতে হবে একটি বছর তাদের৷ পদ্মার দুই পারে আজ প্রতিমা বিসর্জনের তড়িঘড়ি, সজ্জিত দুই কূল আজ দেবীর বিদায়বেলার অন্তিম অনন্দের মূহুর্তে৷ এবার দেবীর বিদায়ের পালা, চারিদিকে " আসছে বছর আবার হবে" রব উঠেছে, দুই কূলই আজ মেতেছে সিঁদুরখেলায়, চোখের এককোণে শুধু আদ্রতার ছোঁয়া৷ মা যে আবার অপেক্ষায় বাঁচিয়ে রাখবে একটি বছর৷
তবে আজ পদ্মার চোখে অদ্ভুত এক তৃপ্তি,আজ যে দু কূলের মাটি মিলে যাবে তারই কোলে, আজ যে তার ই ছোঁয়ায় তার দুই সন্তান৷
হয়তো দু কূলের মায়েরও আজ পদ্মার তলে একে অপরকে দেখে এক ই প্রশ্ন," ভাগটা কিসের?"
আর কাশফুলের গন্ধ অতিক্রম করে ভেসে আসতে লাগল বাংলার একত্র গন্ধ, তবে শুধু লেখকের খাতায় আর কবিদের ছন্দে৷
কাঁটাতারের ওপারে আজও কতো মা অপেক্ষায় তার ছেলের ঘরে ফেরার৷ অতীতের কাছে প্রশ্ন রয়ে যাবে একটাই..
" ভাগটা কিসের ছিল? "
ধর্মের?
তাহলে সেটা ভিত্তিহীন৷
মানুষের আবেগ যে ধর্ম মানে না, আনন্দ যে পার্থিব সম্পদ, আর ধর্ম?
অপার্থিব৷

এ শরৎপার্বণে, কাঁটাতারের বেড়ার ক্ষতের বিসর্জন ঘটুক এ পদ্মার আঁচলে, বাংলা যে আজও অসম্পূর্ণ দেশভাগের যন্ত্রণায়৷