গোধূলি

আজকের সকালটা অনেক আলাদা বাকিদের চেয়ে, আজ যেন দীর্ঘ একশত বছর পর সূর্যের আলোতে কোনও বন্যায় ধ্বংস দ্বীপান্তর আবার নিজের রূপ ফিরে পেয়েছে৷ দূরে কোথাও মাইকে আজহান বাজছে , তারই সাথে তাল মিলিয়েছে সংকীর্তন আর দূরে কোথাও সময়ের অস্তিত্ব জানিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত চার্চের ঘন্টা৷
বেশ কিছুদিন ভাল করে ঘুমতে পারিনি, আজ জানালা দিয়ে পৃথিবীটা দেখে প্রথমবার আক্ষেপ হল, "আর কিছুদিন থাকলেই হতো!"৷ ঠিক দু পা পিছিয়ে ঘরের দিকে তাকাতেই মনে হলো , " নাহ, ভালোই হয়েছে"৷
নিচের ঘরে শুনতে পেলাম মায়ের গলা৷ সে আজকাল বড্ড তাড়াতাড়ি উঠে পরে৷ শুনতে পেলাম সে বোনকে বলছে, " যা দাদাকে ডাক গিয়ে, আর কত যে ঘুমবে, বাড়ি আসলেই কেবল ঘুম আর ঘুম"৷ শুনে শুধুই হাসলাম৷
না খিদে পাচ্ছেনা কেন? ভারি সমস্যা তো!
সেই সকাল থেকে কিছু খাইনি তবু খিদে নেই, না আছে কোথাও যাওয়ার তাড়া৷ সাথে তো ফোনটাও আনলাম না৷ সেই কাল রাতে দুই এক টুকরো কথা বলেছি ওর সাথে৷ কে জানে কলেজ থেকে ফিরল কি না৷ ইসস...

আকাশের রূপটা ক্ষনিকের জন্য বদলে গেল৷ লালচে বিকেলটা যেন কোনও মায়ের আর্তনাদে নিজের রং হারালো৷ একবার বাড়ির দিকে যাব ভাবলাম, সাহস হলো না৷ তাহলে যাব কোথায়? একবার ভাবলাম যাই ওর কাছে ,জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা যায় যদি, যদি একবার ওর হাসি টা দেখতে পেতাম৷ কিন্তু ওর সামনেই বা দাড়াবো কোন মুখে৷ হঠাৎ দূরে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমার পুরোনো বন্ধুকে৷ জড় গলায় ডাকলাম, " কিরে হতভাগা , তুই এখানে কি করছিস?"৷ সে কেবলই বললে, " এই যে মুহূর্তে বেঁচে আছি"৷ দেখলাম দূরে রাস্তা দিয়ে এক বৃদ্ধা হেঁটে চলেছে৷ "কিন্তু কিন্তু, এটা যে তোর মা", বলতেও সে নিরবে চেয়ে রইল আমার কোনও কথার উত্তর না দিয়ে৷

তারপর ঘরে ফিরেছিলাম আমি একবার৷ বাড়ির গেটের বাইরের ভিড় কাটিয়ে ঢুকতেই দেখি মা বসে গেটটাকে জড়িয়ে ধরে৷ বাবা কেমন থমকে দাড়িয়ে আছে৷ বোন কান্নায় লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে৷ বলতে ইচ্ছে করল একবার মায়ের কানে, " মা, রাজার সময় ফুরিয়েছে" ৷ কিন্তু সাহস হলো না৷ আসতে আসতে দেখলাম গাড়ির পিছনে মা দৌড়চ্ছে, সে লুটিয়ে পড়েছে রাস্তার মাঝে৷
নিজর কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো, "আমি কি এতটা মূল্যবান ছিলাম?"

রাস্তায় যেতে যেতে মনে হলো ও কি আদতেও জানে যে আর কোনও কফি সপে, কথাহিন বিকেলে কেউ অপেক্ষা করবেনা আর কখনও... মনে হল দেখি ফোনের গ্যালারির কোনও এক কোনে পরে থাকা আমার কোনকোনও ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে কি সে... চোখের কোনে হয়তো এক দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়েছে অবিরাম৷ কিন্তু কাঁদবেই বা কেন ওকে তো সব বলছিলাম আমি৷ শুধু তারিখটা বলা ছিল না৷ বা হয়তো সেটাও বলেছিলাম৷

শ্মশানের চুল্লীটে ধুকতেই ঠান্ডা শরীরের অবশিষ্ট স্বপ্ন টুকু ক্ষনিকের জন্য রাতের তারাদের মাঝে মিশে গেল৷ তারপর?
তারপর আমার সাথেই পুড়ে গেল একটা আধপেটা ছেলের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে চাহনি৷ পুরে গেল কোন ক্যানসার আক্রান্তের প্রতি মুহূর্তের জ্বালা৷ জ্বলতে থাকল ধর্মের প্রতি পান্ডুলিপি৷ চারিদিকে জলন্ত রণভূমি, তার মাঝেও বার বার দেখতে পেলাম মায়ের মাটিতে লুটিয়ে পরা আর দেখলাম কোনও এক ঘরের কোনে দ্রির অপেক্ষা একজনের.....

মনে হলো থেমে যাই....

No comments:

Post a Comment