ভাবী খ্রিষ্ট যুগের এপারে, যখন ভাড়জীল আর হড়াস আগস্টাসের ইতিহাসের পাতায় ল্যাটিন
সাহিত্যের জন্ম-অধ্যায় লিখছে,তখন উজায়েনের রাজা
বিক্রমাদিত্যের সভায় জন্ম আমাদের কার্ত্তিকের পিতার।
লোকে বলবে কেন, কার্ত্তিক তো মহাদেবের পুত্র...
আমি কিন্তু কার্ত্তিক কে দেখতে পাই কালিদাসের
কুমারসম্ভবে তার নিজের পুত্র রূপে। ঠিক যেমন হড়াস লিখে গিয়েছিলেন পৃথিবীর প্রথম
আত্মজীবনী, তেমনই যদি বলি কালিদাসের হাতে
জন্ম নিয়েছে যুদ্ধের দেবতার জন্ম-গাঁথা।
রাজকন্যা বিদ্যোত্তমার সাথে তার বিয়ের পরই যে
তাদের ভাব-ভালোবাসা লোপ পেয়েছিল সেটা কম-বেশী সবারই জানা। বিয়ের পরই তাকে মূর্খ
বুঝে বিদ্যোত্তমা তাকে ছেড়ে চলে জান। ফলে কালিদাস বেড়িয়ে পড়েছিলেন জ্ঞান অর্জনের
জন্যে। তারপর কেটে গিয়েছে ১৫০০ বছর...
আজ সে থাকে কোলকাতা শহরের কোনও এক গলিতে যার নাম
হয়তো গুরুদাস দত্ত লেন। তার ঘরে সারাদিন টিমটিমে আলো জ্বলে আর ঘন ঘন কাশির শব্দ
আসে। তিনি প্রতি শতাব্দীতে বিবাহ বিচ্ছেদ সহ্য করে আজ বড্ড ক্লান্ত। কখনও তাকে একা
করে গিয়েছে তার নাইট গার্ডের চাকরি আবার কখনো তাকে ডুবিয়ে ছেড়েছে তার অস্থায়ী
ব্যবসা। সব শোকেই তার সঙ্গ দিয়েছে তার বিবাহ বিচ্ছেদ। তার ছেলে আজ তাকে দেখেনা।
শুনেছি ছেলেকে বেশ কিছু বছর কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায়ও আর দেখা যায়না।
কালিদাস কিন্তু আজও জীবিত, অহরহ ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়ে চলেছে তার জীবন।
কুমারসম্ভব আওড়িয়ে আর ডাস্টবিনের পচা খাবারেই নিঃশ্বাস বহাল তার। রাতে তাকে মাঝে
সাঝেই দেখি উল্টোডাঙ্গা ফুটব্রিজের নিচে বসে কুকুরদের থেকে খাবার ছিনিয়ে নিতে।
হয়তো তার বিদেশী ছেলে তার খোঁজ করেছিল,কিন্তু তাকে দেখে
আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারও “সমাজ কি বলবে ?” এই মাথাব্যাথাটা রয়েই গিয়েছে। কার্ত্তিক যে শুধু কালিদাসের ছেলে সেটা
সে কখনও ভাবেনি, ছেলেকে বাবার পরিচয় সে কখনো দেননি।
দিয়েছে বলতে তার নাম,দিয়েছে বলতে তার ধরন আর দিয়েছে এক
অন্য জগৎ যেখানে সে তার কেবল সৃষ্টি-কর্তা। তবে হাতে করে মানুষ সে নিজেই করেছে।
গর্ভে ধারণের ব্যথাও যেন সে পার্বতীর সাথে ভাগ করে নিয়েছেন। তবু সে ছেলের শোকই
তাকে আজ পথে নামিয়ে আনল।
আজ গুরু দাস দত্ত লেনের বাড়িটায় আমি থাকি,আর থাকে আমার ভেঙে যাওয়া অজস্র স্বপ্ন। বহু শতাব্দী ধরে
অপেক্ষা করেছি যে বিদ্যোত্তমার জন্যে,সেও যে আর কখনও মুখ
ফিরিয়ে চায়নি। ১৫০০ বছর ধরে জমিয়ে রাখা কত অভিমান বেঁধে রেখেছিলাম কুমারসম্ভবের
প্রতি অক্ষরমালায়,আজ আর সেগুলো কই?
আমি জানি তারা কোথায়,
তারা ‘৭০এর কবিতা সমগ্রহে মিশে গিয়েছে ইতিহাসের পাতায় আর আগুন জ্বালিয়েছে বই
মেলায়...
সারাদিন পরে থাকি সেই উল্টোডাঙ্গার ফুট ব্রিজের
নিচে,পাগলের মত বসে থাকি বিদ্যতমার
পথ চেয়ে। খাওয়ার জন্য টাকা নেই আর পরনের জামা কাপড়েরও আজ খারাপ দশা। খাবার জুটে
যায় দিব্যি কুকুরের মুখ থেকে ...
বিদ্যোত্তমার অপেক্ষায় পচা খাবারও সুস্বাদু হয়ে
ওঠে আর মাথার ওপর দিনের শেষে এই ভাঙ্গা বাড়ি থেকেই যায়।
আমি পাগল না...
সেদিন ছেঁড়া সালের আড়ালে কার্ত্তিককে দেখেছিলাম
আমার দিকে বিষণ্ণতার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে...
আমি ফিরে যাইনি তার কাছে, ফিরে চেয়েও দেখিনি তার দিকে।
আমি কালিদাস।।
No comments:
Post a Comment