আমি

শ্মশানের দেবদারু গাছ আজ নীরব সাক্ষী কতো জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের। সারা শ্মশান জুড়ে কেবল সে নিজেই প্রাণ সঞ্চার করেছে আর কেঁদেছে প্রতি অগ্নিশিখায় পুড়ে যাওয়া আপন জনের ব্যথায়। ছোট বেলা থেকেই খুব কাছ থেকে দেখছিলাম এই দেবদারু গাছটিকে।ক্লান্ত এক সদ্য পিতা হারানো মেয়ে সেদিন গাছটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, তার বাবার কঠোরতা সে খুঁজে পেয়েছে গাছটির মধ্যে। কোন এক বিকেল বেলা, যখন সমস্ত শ্মশান শান্ত, আগুনের ফুঁপিয়ে ওঠার কারণ নেই, আর নিচে গঙ্গা ঘাটে মৃদু হাওয়া দিয়েছে, তখন দেবদারু গাছটি দুলেছে মৃত্যু-রচনার খেলায়। গাছটি সকলকে চিনত, সে প্রতিটি পুড়ে যাওয়া মানুষের আপন জন। তাকে খুব একটা কেউ পাত্তা দিত না। কেবল কখনও রোদ থেকে বাঁচতে আর কখনও নিজের দুঃখ দূর করতে তার নিচে দুদণ্ড বসত মানুষে।

তার কেবল একটাই সঙ্গী ছিল, তাকে সে দেখেনি কোনও কালে, কেবল দূর পশ্চিম থেকে মাঝে মাঝে সে ডাক শুনেছে তার আপন জনের। তবে দেখা হয়েছিল তার সাথে, এক অন্ধকার অহেতুক রাতে স্বপ্নের অলংকারে। দেবদারুর সঙ্গী আর কেউ নয়, আমি ই ছিলাম। আমি জীবিত নই, তবু জীবন এখনও আমার হাত ছেড়ে দূর জলাশয়ে স্নিগ্ধ হতে চায়নি। বৃষ্টির রাতে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া গাছটির সাথেই যেন মৃত্যুকে গলায় লাগিয়েছি নিজের মনে করে। ছোট থেকে অনেক দৌড়েছি , কখনও দৌড়েছি প্রতিশোধে আবার কখনও দৌড়েছি প্রতিযোগী রূপে। হাঁটার সুযোগ পাইনি কখনও সেরকম ভাবে, তাই পথের আশেপাশে সবটাই অচেনা-অজানা ছিল। কিন্তু আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো যেদিন ব্যর্থতা আছড়ে পড়লো, সেদিন জীবনের গতিবেগ উধাও হয়ে গেল। তারপর শুরু হল নতুন করে চেনা, চিনলাম পথের ধারের জীবনকে। হাঁটতে হাঁটতে একদিন পৌঁছলাম শ্মশানের কাছে। দূর থেকে তখন ডাকছে দেবদারুর ছায়া আর কালো ধোঁয়া।

দৌড়োতে দৌড়োতে কত ইতিহাসের রক্তাক্ত পাতা উলটেছি হতাশায় , দৌড়োতে দৌড়োতে রাজনীতিকে রক্ত শুষে নিতে দেখেছি প্রতি পলকে। ৭০ সালে হঠাৎ একদিন দেখলাম দৌড়ে চলা আর নয়, ঘুরে দাঁড়ানোকেই লড়াই  বলে। বন্দুকের গুলিতে কানে তালা ধরিয়ে দেওয়া প্রতি মুহূর্তে জীবন হারিয়েছে কত নিরীহ। পেন হাতে শেষ চিঠি লিখেছে কত কবি , আর গলায় দড়ি দিয়েছে নাটকের সেট।
কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ছিল যে,
নাহ, ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই তাদের কোমর ভেঙে দেয় রাজনীতি, আর বাকি কাজ করে দেয় ব্যর্থতা।

আমার বনলতা,
তাকে দেখেছিলাম যখন সে হাজারো পুরুষদের মাঝে একা ধেয়ে এসেছিল নারী শক্তি রূপে। সে মনের দিক থেকে আমার থেকে ঢের শক্ত। আমি কোন কালে শক্ত মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়নি। এই বনলতা একদিন আবার হারিয়ে গেল। আসলে তার বোধ হয় কালিদাসের কবিতা পছন্দ কেবল, কালিদাস নয়।
তারপর আবার দৌড়, এবার দায়িত্বের দিকে।আসলে বয়স বেড়েছে, কিন্তু সত্যি কি তাতে কোন যায় আসে?
পথে ছুটতে , আবার দেখা বনলতার সাথে।সে তখন আমার অপেক্ষায় চোখ ভেজায়নি।সে অপেক্ষায় তার দ্বীপ হারানো নাবিকের।চারিদিকে পুড়ছে যখন হাজার চিতা, আর সে সকল চিতার মাঝে লাল শাড়িতে উল্লসিত। হয়ত তার প্রেমিকের খোঁজ মিলেছে এই মৃত- পুরীর অন্তরালে।
ভালবাসা আর হয়নি তারপর, আজ যখন আবার হেঁটেছি একই পথ ধরে, প্রতি মুহূর্তে প্রেমে পড়েছি সেই সাঁওতাল মেয়েটির যার নাম অলকা হতে পারত। তার রূপ আমায় প্রতি মুহূর্তে এক নির্জন সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কোন এক প্রাচীন মণি-মুক্তোর দেশের মতো রহস্যের স্বাদ দিয়েছে।
আর তার হাসি?
শরতের বার্তা বয়ে এনেছে প্রতিক্ষণে। 

কিন্তু…
আবার সেই চারিদিকে আগুন লেগেছে, আবার পুড়ছে সহস্র দেহ, এবার কারণ কি?
এবার কারণ হয়ে দাড়িয়ে ধর্ম।
চারিদিকে ধর্মের নামে মৃত্যু খেলায় মেতে হাজার হাজার ছেলে, এরা কি আদোও ধর্ম বোঝে?
আর সব কিছুর মাঝে ঠিক পাঁচ মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে পুড়ছে আমার সেই সাঁওতাল দ্রৌপদি যাকে চোখে হারিয়েছি বহুদিন।কিন্তু তার এই অবস্থা দেখে এগোতেই , সে বাধা দিল…
সে বললে, “ আর বাঁচতে চাই না, ঢের হয়েছে… নারী হওয়ার শাস্তি আমি পেয়েছি…”
অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম আমার ভালবাসার মৃত্যুর দিকে । তারপর চোখ পড়লো তার ছেঁড়া পোশাকের একটা অংশের দিকে। সেটা উড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল, আর তখনই দেখলাম হত্যাকারীর মুখ, সে পাষাণের থেকেও ভয়ঙ্কর।তারপর ধর্ষণ হয়েছে কত দ্রৌপদি প্রতি অন্ধকার রাস্তায়,তাদের পুড়ে মরতে হয়েছে আরও কত স্ট্রিট ল্যাম্পের রাস্তার মোড়ে।
আর ঘুরে দেখিনি কখনও কোন নারী মূর্তির দিকে…তারা চিরকাল আমায় হতাশ করেছে।

আর দেবদারু গাছটি?
সেও আমার মতোই সাক্ষী সহস্র মৃত্যুর, তাকে বলবার আর কিচ্ছু নেই নতুন করে। আর কিছুক্ষণ, তারপর আমাকেও চলে যেতে হবে এই দেবদারু গাছের ছায়া ছেড়ে।

হঠাৎ ডাক পড়লো দূর থেকে, “ এবার আপনাদের মরা পোড়ানোর পালা…”
ব্যাস… সব শেষ, চারিদিকে স্থির আর আমি এগিয়ে চলেছি অনন্তের ডাকে।
নাহ্।। এখনও আমাকে দেখা যাবে, শ্মশান থেকে উড়ে যাওয়া কালো ধোঁয়ার দলে।
হয়তো পরিচয় দেব তখন দেবদারুর বন্ধু রূপে।

আমি তরুণাভ,
আমি অতীত ।।